বাঁচানো গেল না অগ্নিদগ্ধ সোনাগাজীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে।


rafiq প্রকাশের সময় : এপ্রিল ১১, ২০১৯, ০৩:৪৯ / ২০৯
বাঁচানো গেল না অগ্নিদগ্ধ সোনাগাজীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে।

বিশেষ সংবাদ দাতা অবশেষে সর্বোচ্চ চেষ্টায়ও বাঁচানো গেল না দুর্বৃত্তদের আগুনে দগ্ধ সোনাগাজীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে। সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল না ফেরার দেশে। গতকাল বুধবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছে সে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন। তার মৃত্যুর বিষয়টি জানিয়েছেন বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন। নুসরাতের মৃত্যুর খবর জানতে পেরে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি নুসরাতের চিকিৎসার বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে মনিটরিং করছিলেন।
এর মাত্র আধঘণ্টা আগে রাত ৯টার দিকে নুসরাতের চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান প্রফেসর ডা. আবুল কালাম জানিয়েছিলেন, এই ছাত্রীর শারীরিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। ঢামেক হাসপাতালে আনার পরই চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, নুসরাতের অবস্থা গুরুতর। তার শরীরে প্রায় ৮০ শতাংশই পুড়ে গেছে।
নুসরাতের মৃত্যুর খবরে হাসপাতালে থাকা তার মা-ভাই ও স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে বার্ন ইউনিটের আকাশ বাতাস। সেই দৃশ্য দেখে অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি।
এর আগে গতকাল বুধবার হাসপাতালে নুসরাত জাহান রাফিকে দেখার পর স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান জানিয়েছিলেন, একজন রোগীকে বিদেশে পাঠাতে গেলে অ্যাম্বুলেন্সে তোলাসহ যে ধকল সইতে হয়, এই মেয়েটি (অগ্নিদগ্ধ মাদরাসাছাত্রী) এখন সে ধকল নিতে পারার মতো অবস্থায় নেই। এ বিষয়টি বিবেচনা করে তাকে এখনই সিঙ্গাপুরে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তার অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে তাকে সিঙ্গাপুর নেয়া হবে।
অন্যদিকে ফেনীর সোনাগাজী থানার ওসি মো. মোয়াজ্জেম হোসেনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। একই সঙ্গে মাদরাসাছাত্রীকে হত্যাচেষ্টার মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) হস্তান্তর করা হয়েছে। মাদরাসার প্রিন্সিপাল সিরাজ উদদৌলার সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন ফেনীর আদালত। এছাড়া গ্রেফতারকৃত অন্য ৪ জনকে পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। জড়িত পলাতকদের গ্রেফতারে কাজ করছে পুলিশ। গতকাল পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা এসব তথ্য জানান।
ঢামেকের বার্ন ইউনিটে সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, এই ছাত্রীর শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে গেছে। এরপরও চিকিৎসকরা তাকে সুস্থ করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা কররেন। ডা. রায়হানা আওয়াল সুমিসহ অন্যরা চিকিৎসা করছেন। প্রধানমন্ত্রী ফুলটাইম মনিটরিং করছেন। দফায় দফায় চিকৎসকরা তার আপডেট জানাচ্ছেন। তাকে প্রধানমন্ত্রী সিঙ্গাপুরে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দেয়ার কথা বলেন। এখানকার চিকিৎসকরা সিঙ্গাপুরের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। এ সময় ডা. মুরাদ হাসান বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও আমি নিজে মেয়েটিকে নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। তার চিকিৎসার ব্যাপারে আমরা ওয়াকিবহাল থাকছি।
সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, বুধবার সকালে তাকে নিয়ে আমরা আবারও সিঙ্গাপুরের চিকিৎসদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করেছি। তারা আমাদের কাছে কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চেয়েছেন। আমরা তা পাঠিয়েছি। সেখানকার মেডিক্যাল বোর্ড, আইসিইউ চিকিৎসক, মেট্্েরালজিস্ট, প্লাস্টিক সার্জনসহ সব চিকিৎসক মিলে সিদ্ধান্ত নেন যে, রোগীর এখন যে অবস্থা, তাতে তাকে জার্নি করে সিঙ্গাপুরে নেয়া কঠিন হবে। তাকে বিদেশে নেয়ার ব্যাপারে আরও অপেক্ষা করা উচিত।
সামন্ত লাল সেন আরো বলেন, মঙ্গলবার আমরা যে অপারেশন করেছি, এতে তার শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার একটা উপায় তৈরি করেছি। তার শরীরের চামড়াটা ফুটো হয়ে যাওয়ায় বুকে চাপ ধরেছিল, যার কারণে সে শ্বাস নিতে পারছিল না। আমরা অপারেশন করে শ্বাস নেয়ার ব্যবস্থা করেছি। তার অবস্থা কোনো পরিবর্তন হয়নি। সিঙ্গাপুর থেকে কোনোও খবর আসলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ সময় ডা. রায়হানা আওয়াল সুমি, ডা. নওয়াজেশ আহমেদ, ঢামেকের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনালের এ কে এম নাসিরুদ্দীনসহ অন্য চিকিৎসকরা উপস্থিত ছিলেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক সূত্র জানায়, সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে (এপিবিএন) বদলি করা হয়েছে। ছাত্রীর পরিবারের অনাস্থা আমলে নিয়ে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কোনোভাবেই যেন মামলাটি ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং স্থানীয় কেউ যেন প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, সে জন্যই দায়িত্ব পিবিআইকে দেয়া হয়েছে। জড়িত অন্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। এছাড়া আটক দু’জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন তদন্তের সাথে জড়িত কর্মকর্তারা।
ফেনী জেলা সংবাদদাতা মো. ওমর ফারুক জানান, ফেনীর পুলিশ সুপার এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার বলেন, মামলার নথিপত্র ফেনী পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মনিরুজ্জামানের হাতে হস্তান্তর করা হয়েছে। বুধবার দুপুরে প্রধান আসামি সিরাজ উদ্দৌল্লাহ, প্রভাষক আফছার উদ্দীন ও আলিম পরীক্ষার্থী আরিফুল রহমানকে আদালতে হাজির করা হয়। ফেনীর চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শরফুদ্দিনের আদালতে হাজির করে পুলিশ আসামিদের রিমান্ড দাবি করে। এসময় আদালত প্রধান আসামির ৭ দিন, অপর ২ জনের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রাফিকে আগুনে ঝলসে দেয়ার ঘটনায় আদালত এ পর্যন্ত ৭ আসামির রিমান্ড মঞ্জুর করেছে। এর আগে মঙ্গলবার ৪ আসামিকে আদালতে হাজির করে ৭ দিনের রিমান্ড চায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। এসময় আদালত আসামি নুর হোসেন, আলাউদ্দিন, কেফায়েত উল্যাহ ও সাইদুল ইসলামের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এছাড়া ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে মঙ্গলবার রাতে জোবায়ের আহমদ নামে আরেক মাদরাসাছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। শম্পা সন্দেহে প্রিন্সিপালের শ্যালিকার মেয়ে পপিকে আটক করা হলেও সে এখনো থানা হেফাজতে রয়েছে। সার্বিক বিষয়ে জানতে মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সদস্য ও উপজেলা আ’লীগ সভাপতি রুহুল আমিনের কাছে ফোন করা হলে তিনি বলেন, এটি সোনাগাজীর ইতিহাসে ন্যাক্করজনক ঘটনা। প্রকৃৃত অপরাধীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির দাবি জানান তিনি।
উল্লেখ্য, গত ৬ এপ্রিল শনিবার সকাল ৯টার দিকে আলিম পর্যায়ের আরবী প্রথমপত্র পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসা কেন্দ্রে যায় ওই ছাত্রী। এরপর কৌশলে তাকে পাশের ভবনের ছাদে ডেকে নেয়া হয়। সেখানে বোরকা পরিহিত ৪/৫ ব্যক্তি ওই ছাত্রীর শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে তার শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে যায়। পরে ওই ছাত্রীকে উদ্ধার করে তার স্বজনরা প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে ফেনী সদর হাসপাতালে পাঠান। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পর তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ওই ছাত্রী লাইফ সাপোর্টে চিকিৎসাধীন। সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল সিরাজউদ্দৌলা-এর আগে ওই ছাত্রীকে যৌন নিপীড়ন করে। এ কারণে গত ২৭ মার্চ তাকে আটক করে পুলিশ। এ ঘটনায় মেয়েটির মা বাদী হয়ে সোনাগাজী থানায় মামলা করেন

ব্রেকিং নিউজ :
Shares