লাইফ সাপোর্টে -মাদরাসাছাত্রী নুসরাতের অস্ত্রোপচার।


rafiq প্রকাশের সময় : এপ্রিল ১০, ২০১৯, ০৩:৫০ / ১৮৫
লাইফ সাপোর্টে -মাদরাসাছাত্রী নুসরাতের অস্ত্রোপচার।

বিশেষ সংবাদ দাতা ফেনীর সোনাগাজীতে অগ্নিদগ্ধ মাদরাসাছাত্রী নুসরাতের অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। ভেন্টিলেশনে (লাইফ সাপোর্ট) রেখেই গতকাল মঙ্গলবার সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দুই ঘণ্টাব্যাপী এ অস্ত্রোপচার চলে। তার ফুসফুস সক্রিয় রাখতে এ অস্ত্রোপচার হয়েছে। এ মুহূর্তে তাকে সিঙ্গাপুরে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকদের পরামর্শে এ অস্ত্রোপচার হয়েছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন এসব তথ্য জানান।
অন্য দিকে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় আলোচিত শম্পাকে জিজ্ঞাবাসাদের জন্য আটক করেছে পুলিশ। গতকাল সকালে শম্পাকে আটক করা হয় বলে জানিয়েছেন ফেনী জেলার পুলিশ সুপার এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার। এ ছাড়া গ্রেফতারকৃতদের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
সামন্ত লাল সেন আরো বলেন, মেয়েটির শারীরিক যে অবস্থা তাতে ৫ ঘণ্টা ফ্লাই করা খুবই রিস্কি বলে মনে করছেন সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকরা। মেয়েটির যেসব সমস্যা আছে, সেগুলো স্থিতিশীল হলে তখন তাকে সিঙ্গাপুরে নেয়া যাবে। আমরা এ বিষয়টি তার পরিবারকেও জানিয়েছি, তারাও একমত পোষণ করেছেন।
সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকদের পরামর্শে এ অস্ত্রোপচার হয়েছে উল্লেখ করে নুসরাতের চিকিৎসায় গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডের প্রধান প্রফেসর ডা. আবুল কালাম জানিয়েছেন, নুসরাতের চিকিৎসার আপডেট রিপোর্ট নিয়মিত সিঙ্গাপুরে পাঠানো হবে। যেহেতু ওর অবস্থার অবনতি হয়, তাই আমরা ভেন্টিলেশনে নিয়ে আজ অপারেশন করি। তার পরিবারও আমাদের সঙ্গে চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে একমত হয়েছে। তার অবস্থা কালকের চেয়ে ভালো।
তিনি বলেন, আমরা ওর পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্টগুলো প্রতিদিন সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালকে মেইল করব। কোনো কিছু মনিটর করতে হলে তারা আমাদের মেইলে জানাবে। প্রতিদিন তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ থাকবে। এ ছাড়া ১৪ তারিখ এদের সঙ্গে আমাদের একটা প্রোগ্রাম আছে এখানে। তারা বাংলাদেশে পাঁচ দিন থাকবে। সে পর্যন্ত যদি মেয়েটি ভালো থাকে তাহলে তাকে এরা দেখবে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, আমরা ওর (নুসরাত) জন্য দিনরাত কাজ করছি। আপনারা সবাই দোয়া করবেন।
গত ৬ এপ্রিল শনিবার সকালে ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসা কেন্দ্রে আরবি প্রথম পত্রের পরীক্ষা দিতে যায় নুসরাত। তাকে ছাদে ডেকে নিয়ে বোরখা পরা চার নারী মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়। তাতে রাজি না হওয়ায় ওড়না দিয়ে হাত বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। অগ্নিদগ্ধ নুসরাতকে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হয়। সেখান থেকে ফেনী সদর হাসপাতালে এবং পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া নুসরাতের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হওয়ায় সোমবার তাকে নেয়া হয় লাইফ সাপোর্টে। সোমবার বিকালে তাকে দেখতে বার্ন ইউনিটে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও আওয়ামী লীগের উপদফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়–য়া সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী তাকে সিঙ্গাপুর পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন এবং সিঙ্গাপুরে পাঠানোসহ চিকিৎসার সব খরচ সরকার বহন করবে।
এদিকে নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টার ঘটনায় বোরখা পরিহিত অজ্ঞাত পরিচয় চার নারীসহ কয়েকজনকে আসামি করে সোমবার মামলা করেছেন তার ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান। ওই ঘটনায় এ পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ছাড়া নুসরাতের শ্লীলতাহানির মামলায় ওই মাদরাসার প্রিন্সিপাল কারাগারে রয়েছেন। তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে মাদরাসার গভর্নিং বডি।
এর আগে গত ২৭ মার্চ নুসরাতকে যৌন হয়রানির চেষ্টা করেন সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল সিরাজ উদ-দৌলাহ। এ অভিযোগ এনে ছাত্রীর মা বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন। মামলার পর পুলিশ প্রিন্সিপালকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠায়। ওই ঘটনার পর থেকে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ প্রিন্সিপালের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করে। অন্য দিকে আরেকটি অংশ শিক্ষকের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন করে।
ডিআইজির ঘটনাস্থল পরিদর্শন
সোনাগাজী (ফেনী) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, নুসরাত জাহান রাফির গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে হত্যার চেষ্টার ঘটনায় মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি বলেন, এটা একটা দুঃখজনক ঘটনা। ঘটনার পর থেকে পুলিশ প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেফতারের চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে দুইজন এজাহারভুক্তসহ সন্দেহমূলক আরো ৫ জনকে আটক করতে সক্ষম হয়েছি। তবে তদন্তকাজ অব্যাহত রয়েছে। আমরা গণমাধ্যম কর্মীসহ সবার সহযোগিতা কামনা করছি।
অন্য দিকে থানা ও ডিবি পুলিশ পৃথক পৃথক অভিযান চালিয়ে মোট ৭ জনকে গ্রেফতার করেছে। তারা হচ্ছে- ওই মাদরাসার নাইটগার্ড ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মো. মোস্তফা, দপ্তরি মো. নূরুল আমিন, মাদরাসার প্রাক্তন ছাত্র সাইদুল হক, প্রিন্সিপালের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধনে অংশ নেয়া যুবক জসিম উদ্দিন, আলা উদ্দিন; এর আগে ঘটনার দিন মাদরাসার ইংরেজি প্রভাষক আবছার উদ্দিন ও আলিম পরীক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম। তাদেরকে ওই মামলায় সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
সোনাগাজী মডেল থানার ওসি মো. মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, আহত ছাত্রীর বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান এজাহারে উল্লেখ করেছেন, গত ২৭ মার্চ সকাল ১০টার দিকে মাদরাসার প্রিন্সিপাল এস এম সিরাজ উদ-দৌলাহ অফিসের পিয়ন নূরুল আমিনের মাধ্যমে তার বোনকে ডেকে নিয়ে পরীক্ষার আধা ঘণ্টা আগে প্রশ্নপত্র দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। ঘটনাটি গভীরভাবে অনুসন্ধান চলছে। অভিযান অব্যাহত রয়েছে। রাফি বর্তমানে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রয়েছে। রাফি সোনাগাজী পৌর এলাকার উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের মাও. এ কে এম মুসা মানিকের কন্যা। রাফির বাবাও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার একটি মাদরাসার শিক্ষক।
শম্পা সন্দেহে পপি আটক
ফেনী জেলা সংবাদদাতা জানান, ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র মাদরাসার অগ্নিদ্বগ্ধ আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় আলোচিত শম্পা সন্দেহে পপি নামে এক ছাত্রীকে আটক করেছে পুলিশ।
প্রধানমন্ত্রী মাদরাসা শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নেয়ায় জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের মোবারকবাদ
অগ্নিদগ্ধ মাদরাসা শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফির সার্বিক চিকিৎসার ব্যয়ভার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই নিয়েছেন, এ সংবাদে দেশের মাদরাসা শিক্ষক কর্মচারীদের একমাত্র পেশাজীবী অরাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন তাঁকে আন্তরিক মোবারকবাদ জানিয়েছে। সেই সাথে মাদরাসা শিক্ষার্থীকে অগ্নিদগ্ধ করার ঘটনার দ্রুত তদন্ত করে অপরাধীদের চিহ্নিত করে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদানের যে নির্দেশনা দিয়েছেন সেজন্যও তাঁকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছে। সংগঠনের সভাপতি আলহাজ এ এম এম বাহাউদ্দীন ও মহাসচিব আলহাজ প্রিন্সিপাল মাওলানা শাব্বীর আহমদ মোমতাজী এক বিবৃতিতে বলেন, আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফির চিকিৎসা সরকারিভাবে সম্পন্ন করার ঘোষণা দিয়ে নিঃসন্দেহে প্রধানমন্ত্রী এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। তাঁর এ মহতি উদ্যোগের জন্য দেশের সকল মাদরাসা শিক্ষক-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবেন। নেতৃবৃন্দ সকল মাদরাসা শিক্ষক-কর্মচারী, শিক্ষার্থী, দরবার, খানকাসমূহে নুসরাত জাহান রাফির দ্রুত আরোগ্য লাভে প্রধানমন্ত্রীর সু-স্বাস্থ্য ও নেক হায়াতের জন্য বিশেষ দোয়া করার অনুরোধ করেছেন।
ফেনী জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের স্মারকলিপি
ফেনীতে মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির ওপর বর্বরোচিত হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় অপরাধীদের চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করার দাবিতে জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেছেন জমিয়াতুল মুদার্রেছীনের ফেনী জেলা শাখার নেতারা।
জেলা জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি মাওলানা হোছাইন আহাম্মদ ভূঁইয়া, সেক্রেটারি মাওলানা নুরুল আবছার ফারুকী, সহসভাপতি মাওলানা ছিদ্দিক উল্লাহ, মাওলানা নুরুল ইসলাম মজুমদার, ফাজিলপুর ওয়ালিয়া ফাযিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা মাঈন উদ্দিন খোন্দকার, দাগনভূঁইয়া আজিজিয়া ফাযিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা ফারুক আহম্মেদ মজুমদার, দরবেশের হাট ফাযিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আবুল কালাম আযাদ, দাইয়াবিবি আজিমুদ্দিন আলিম মাদরাসার প্রিন্সিপাল মোহাম্মদ হোছাইন, গুনক ওলীপুর ফাযিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহমুদুল হক, রাজাপুর আলিম মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা নুরুন্নবী, খাদিজাতুল কুবরা মহিলা মাদরাসার সুপার মাওলানা আবুল কাশেম, পাঠাননগর আমিনিয়া ফাযিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা মশিউর রহমান, নিজকুঞ্জরা ফাযিল মাদরাসার প্রভাষক মো. কামরুল হাছান মজুমদার, মৌলভী শামসুল হক দাখিল মাদরাসার সুপার মাওলানা আনোয়ার, ধর্মপুর আলিম মাদরাসার সহ-সুপার মাও. ছানা উল্লাহ, সিলোনিয়া ফাযিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা গোলাম কিবরিয়া প্রমুখ।
স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, আলিম পরীক্ষার্থী রাফির ওপর যে বা যারা অগ্নিসংযোগ করেছে, তাদের অবিলম্বে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হোক। মাদরাসাছাত্রীর ওপর এ হামলা সমগ্র মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। পরীক্ষা চলাকালে কেন্দের ও আশপাশে ১৪৪ ধারা জারি থাকে। এ নিরাপত্তার পরও কে বা কারা এমন দুঃসাহস দেখিয়ে রাফির ওপর অগ্নিসংযোগ করল তা প্রশাসন খতিয়ে দেখবে বলেও তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

ব্রেকিং নিউজ :
Shares