দুই সরকারের কর্মকর্তার অবৈধ লেনদেন নিয়ে তোলপাড়


rafiq প্রকাশের সময় : জুন ১৩, ২০১৯, ০৪:৪৭ / ১৮৮
দুই সরকারের কর্মকর্তার  অবৈধ লেনদেন নিয়ে তোলপাড়
  • রফিক চৌধুরী  এ যেন শেয়ানে শেয়ানে লড়াই। দুর্নীতি দমন কমিশনের এক পরিচালক ও পুলিশের এক ডিআইজির মধ্যে ঘুষ দেয়ানেয়া নিয়ে লড়াই। দর্শক দেশের ১৭ কোটি মানুষ। ঘুষ দেয়া এবং ঘুষ নেয়া নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির ও পুলিশের ডিআইজি মিজানুর রহমানের মধ্যে চলছে লড়াই। এই লড়াইয়ে কে হারে আর কে জেতে, সেটা দেখার জন্য মানুষ অপেক্ষা করছে। দুদক পরিচালক ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার এই ঘুষ লেনদেন নিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, এই দায় দুর্নীতি দমন কমিশন এড়াতে পারে না। আবার ঘুষ নেয়ার অভিযোগ ওঠার পর দুদক পরিচালক এনামুল বাছিরকে সাময়িক বরখাস্তের ২৪ ঘণ্টা পর দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ দাবি করছেন- ‘ঘুষের কারণে নয়, তথ্য পাচারের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।’ ঘুষ ইস্যুতে হঠাৎ চেয়ারম্যানের ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আর ডিআইজি ঘুষ দেয়ার কথা ঘোষণা দেয়ার পর নিজ পদে বহাল থাকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘ডিআইজি মিজান নিশ্চয়ই অপরাধ ঢাকতে ঘুষ দিয়েছেন। তার আগের অপরাধের বিচার চলছে। নতুন করে যদি ঘুষ দেয়ার মতো অপরাধ করে থাকেন, তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

    খন্দকার এনামুল বাছিরকে সাময়িক বরখাস্তের পর পুলিশের ডিআইজি মিজানুর রহমানের সম্পদ অনুসন্ধানে নতুন করে পরিচালক মর্যাদার এক কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। নতুন অনুসন্ধান কর্মকর্তা হলেন দুদক পরিচালক মঞ্জুর মোরশেদ। গতকাল বুধবার সেগুনবাগিচায় দুদক প্রধান কার্যালয়ে এ তথ্য জানান দুদক কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান।

    রাষ্ট্রের দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান দুদকের পরিচালকের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ ওঠায় গতকাল নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের দুদক চেয়ারম্যান জানান, ‘ঘুষের বিষয় নিয়ে মিডিয়ায় ভুলভাবে উপস্থাপন হয়েছে। তথ্য টুইস্ট করা হয়েছে। আমরা তাকে (এনামুল বাছির) ঘুষের কারণে বরখাস্ত করিনি। এটা তো প্রমাণের বিষয়। দুদকের অভ্যন্তরীণ তথ্য বাইরে কিভাবে গেল, সেটাই বড় প্রশ্ন। এতে আচরণবিধি লঙ্ঘিত হয়েছে। যদিও এটাও প্রমাণের বিষয়।’ সাময়িক বরখাস্তের পরও এনামুল বাছির দুদক অফিসে কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যম ভুল, মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশন করে আমার ক্ষতি করছে, তারা যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন মনে করছে না। আমার ক্ষতি করে কুশল ও সালাম বিনিময় অপ্রয়োজনীয়। সাংবাদিকদের এড়াতে সাড়ে ১২টায় দুদকে ঢুকলাম। তবুও সাংবাদিকদের কাছ থেকে ছাড় পেলাম না।’ এর আগের দিন দুদক বরখাস্ত পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির দাবি করেন, তার বিরুদ্ধে ঘুষ নেয়ার অভিযোগ বানোয়াট ও ডিজিটাল জালিয়াতি। ডিআইজি মিজানের সঙ্গে কথোপকথনের অডিও রেকর্ডটি ‘ম্যানুফ্যাকচারিং’ এবং মিথ্যা।

    তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, দুর্নীতি তদন্তের রিপোর্ট ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য পুলিশ কর্মকর্তার কাছে ৪০ লাখ টাকা ঘুষের অভিযোগই নয়; দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এর আগেও একবার ৪০ মাস সাময়িক বরখাস্ত ছিলেন। তখন ৩৫০ কোটি টাকা উদ্ধার-সংক্রান্ত একটি মামলার তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। তদন্তে অসততার অভিযোগ উঠলে তাকে বরখাস্ত করা হয়। পরে পরিস্থিতি সামলে উঠে চাকরিতে পুনর্বহাল হন, পদোন্নতিও পান।

    ১৯৯১ সালে এনামুল বাছির দুর্নীতি দমন ব্যুরোতে যোগ দেন। পরিচালক হওয়ার আগে দুদকের আইন বিভাগের উপ-পরিচালকও ছিলেন। অসততার অভিযোগে আগেও ৪০ মাস সাময়িক বরখাস্ত থাকার বিষয়টি সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করে খন্দকার এনামুল বাছির বলেছেন, ‘দুর্নীতি দমন ব্যুরো থেকে যখন দুর্নীতি দমন কমিশন হলো, তখন ৪০ মাস চাকরি ছিল না। ব্যুরো আমলে আমি একটা মামলা তদন্ত করেছিলাম, তাতে ৩৫০ কোটি টাকা রিকভার হয়েছিল। সেই সময়ে বিবাদী পক্ষ ব্যুরোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন পর্যায় পর্যন্ত কিনে ফেলে। তারা আমাকে ঘরে পর্যন্ত ঘুমাতে দেয়নি। কিছু দিন পর পর আমার কর্মস্থলও পরিবর্তন করা হতো। যখন কমিশন হয় তখন আমাকে অবহেলা করা হয়েছিল। আমার কাছে এবারের অভিযোগ নতুন কিছু নয়।

    এ দিকে নারী নির্যাতনের অভিযোগে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা মিজানুর রহমান ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দেয়ার অভিযোগ তুলে আবার আলোচনায় চলে এসেছেন। দুদক কর্মকর্তাকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে বিতর্কিত ডিআইজি মিজানুর রহমানের সম্পদ নিয়ে কৌত‚হল সৃষ্টি হয়েছে মানুষের মধ্যে। প্রশ্ন উঠেছে- যিনি দুর্নীতি থেকে বাঁচতে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে পারেন, তার সম্পদের পরিমাণ কত? মিজানুর রহমানের সম্পদের কিছু তথ্য মিডিয়ায় উঠে এসেছে। সেগুলোর মধ্যে সাভারে নিজের নামে ৫ কাঠা জমি, পূর্বাচল নতুন শহর এলাকায় ৫ কাঠা জমি, ঢাকায় পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতির পুলিশ টাউনে সাড়ে ৭ কাঠা জমি, বরিশালের মেহেদিগঞ্জ পৌরসভায় দোতলা ভবন, কানাডার টরন্টোতে একটি ফ্ল্যাট, স্ত্রী সোহেলিয়া আনার রত্মার নামে উত্তরা রেসিডেন্সিয়াল মডেল টাউনে ১৭৫০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট, রাজধানীর নিউ বেইলি রোডে ছোট ভাই মাহবুবুর রহমান স্বপনের নামে ২ হাজার ৪০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট, রাজধানীর কোতয়ালি থানার পাইওনিয়ার রোডে ভাগ্নে এসআই মাহমুদুল হাসানের নামে ১ হাজার ৯১৯ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট। এ ছাড়াও আরো অনেক সম্পদ তার নামে রয়েছে। দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির গত ২৩ মে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশসহ যে অনুসন্ধান প্রতিবেদন দুদকে জমা দেন তাতে বলা হয়, মিজানের ৪ কোটি ২ লাখ ৮৭ হাজার টাকার সম্পদ আছে। এর মধ্যে তার নিজের নামে আছে ১ কোটি ১০ লাখ ৪২ হাজার টাকার স্থাবর ও ৯৬ লাখ ৯২ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ। বাকিটা আছে মিজানের আত্মীয়স্বজনের নামে। দুদক জানায়, মিজান তার আয়কর নথিতে স্থাবর ও অস্থাবর মিলিয়ে ১ কোটি ৫৩ লাখ ৭০ হাজার টাকার সম্পদ দেখিয়েছেন।

    জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আরো বলেন, পুলিশের ডিআইজি মিজানুর রহমান ঘুষ দেয়ার কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করার পরও তার স্বপদে বহাল থাকা বিস্ময়কর। ঘুষ লেনদেনে জড়িত দুই পক্ষই সমানভাবে দায়ী উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে যখন কোনো ব্যক্তি দুর্নীতির অভিযোগ থেকে পার পেতে ঘুষ দেন, তখন তার অপরাধের মাত্রা আরো গুরুতর হয়। পুলিশ প্রশাসন এখনো কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। দুদক পরিচালকের বিরুদ্ধে ঘুষ নেয়ার অভিযোগ ওঠায় ব্যক্তির দায় প্রতিষ্ঠান নেবে না- দুদকের এমন অবস্থান আমাদের শুধু হতাশই করেনি, বরং আমরা বাংলাদেশে দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমের ভবিষ্যৎ নিয়ে রীতিমতো শঙ্কিত। দুদক এই দায় এড়তে পারে না।

ব্রেকিং নিউজ :
Shares