ভারত পাকিস্তান সিমান্তে তুমুল লড়াই- দুই ভারতীয় বিমান ভূপাতিত ও এক পাইলট বন্দি।


rafiq প্রকাশের সময় : ফেব্রুয়ারী ২৮, ২০১৯, ০৪:৪৯ / ২৫৫
ভারত পাকিস্তান সিমান্তে তুমুল লড়াই-  দুই ভারতীয় বিমান ভূপাতিত ও এক পাইলট বন্দি।

বিশেষ সংবাদ দাতা 
দুই ভারতীয় বিমান ভূপাতিত ও এক পাইলট বন্দি: গতকাল সকালে ভারতের ভেতরে ঢুকে পড়ে পাকিস্তানের যুদ্ধ বিমান। তাদের রুখে দিতে তেড়ে আসে ভারতের মিগ-২১ যুদ্ধবিমান। ধাওয়াকারী ভারতীয় যুদ্ধবিমানগুলো পাকিস্তানের আকাশসীমায় প্রবেশ করলে সেগুলো লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে পাকিস্তানি বাহিনী। ইসলামাবাদের দাবি, গুলিতে ধাওয়াকারী দুইটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয়েছে। অভিনন্দন নামে এক ভারতীয় পাইলটকেও আটক করেছে তারা। পাকিস্তানি সেনাসূত্রে দাবি করা হয়েছে, গতকাল সকালে তাদের যুদ্ধ বিমান ভারতের ভেতরে ছয়টি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে। সেনাবাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল আসিফ গফুর টুইটারে বলেন, পাকিস্তানি যুদ্ধবিমানকে ধাওয়া করে কয়েকটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান লাইন অব কন্ট্রোল অতিক্রম করে পাকিস্তানের আকাশসীমায় প্রবেশ করলে পাকিস্তানি বাহিনী দু’টি যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছে।

এর মধ্যে একটি ভারতশাসিত কাশ্মীরে ও অপরটি পাকিস্তানের আজাদ কাশ্মীরে বিধ্বস্ত হয়েছে। সেখান থেকে দুই ভারতীয় পাইলটকে আটক করেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এদের মধ্যে একজন গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। অন্য ভারতীয় পাইলটের ভিডিও প্রকাশ করেছে পাকিস্তান। এতে দেখা যায়, রক্তাক্ত অবস্থায় ওই পাইলট নিজেকে ভারতীয় বিমান বাহিনীর উইং কমান্ডার অভিনন্দন হিসেবে পরিচয় দেন। ৪৪ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে তিনি নিজের সার্ভিস নম্বরও বলেন। পাকিস্তানি তথ্য মন্ত্রণালয় টুইটারে ওই ভিডিও প্রকাশ করলেও পরে তা সরিয়ে নেয়।

তবে পাকিস্তানের ভূ-খণ্ডে ভারতীয় বিমান বিধ্বস্তের ভিডিওচিত্র তথ্য মন্ত্রণালয়ের টুইটার অ্যাকাউন্টে রয়েছে। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের এক পাইলট নিখোঁজের কথা স্বীকার করলেও পাকিস্তানের প্রকাশ করা ভিডিও’র বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রভিশ কুমার তাদের পাইলট নিখোঁজের খবর নিশ্চিত করে বলেছে, পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান ভারতের ভেতরে সামরিক স্থাপনায় আঘাত হানে। পরে সেগুলোকে ধাওয়া করে ভারতীয় বাহিনী। দুঃখজনকভাবে ভারতের একটি মিগ-২১ বিমান হারিয়েছে।

ওই বিমানের পাইলটও নিখোঁজ রয়েছে। ভারত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রেখেছে বলেও জানান তিনি। তবে ভারতের কোনো সেনা নিহত হয়েছেন কিনা তা স্পষ্ট করেন নি তিনি। এনডিটিভির খবরে বলা হয়েছে, গতকাল সকালে পাকিস্তানের ছোড়া গুলিতে একটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয়েছে। এতে ভারতের ছয় বিমান সেনা ও এক বেসামরিক অধিবাসী নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে গণমাধ্যমটি।

পাকিস্তানি বিমান ভূপাতিত করার দাবি ভারতের: পাকিস্তানের একটি যুদ্ধ বিমান গুলি করে ভূপাতিত করার দাবি তুলেছে ভারত। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রভিশ কুমার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ভারতীয় মিগ-২১ যুদ্ধবিমান থেকে গুলি করে পাকিস্তানের একটি এফ-১৬ ফাইটার জেট ভূপাতিত করা হয়েছে। ওই বিমানটি সীমান্তের ওপারে পাকিস্তানের ভূ-খণ্ডে বিধ্বস্ত হয়েছে। তবে পাকিস্তানের মুখপাত্র মেজর জেনারেল গফুর ভারতের এই দাবি নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, গতকালের আক্রমণে পাকিস্তান কোনো এফ-১৬ বিমান ব্যবহারই করে নি।

সীমান্তে গুলিবিনিময়: বিমান হামলার পাশাপাশি কাশ্মীর সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ রেখায় উভয় দেশের মধ্যে গুলিবিনিময় হয়েছে। বিবিসি’র খবরে বলা হয়েছে, উভয় পক্ষের গুলিবিনিময়ে পাকিস্তানের ৪ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো দশ জন। বিপরীত পাশে, পাকিস্তানি বাহিনীর ছোড়া গুলিতে আহত হয়েছেন ৫ ভারতীয় সেনা। সংঘর্ষের কারণে স্থানীয় স্কুলগুলো বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। সেখানকার বসতবাড়িগুলো থেকে মানুষদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বলা হয়েছে। পাকিস্তানি একটি হাসপাতালের কর্মকর্তা নাসরুল্লাহ খান আল-জাজিরাকে বলেন, এখন পর্যন্ত ৪ জনের মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চরম বিরোধপূর্ণ ও ব্যাপক সামরিক অবস্থান থাকা লাইন অব কন্ট্রোল সীমান্তে উভয় পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি হয়। নাসরুল্লাহ খান বলেন, নিহতদের মধ্যে ২ শিশুসহ এক নারীও রয়েছেন।

শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে মোদির বৈঠক: গতকাল সকালে পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান যখন ভারতের সীমান্ত রেখা অতিক্রম করে ভেতরে প্রবেশ করে, তখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নয়াদিল্লিতে একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করছিলেন।  সেখানে ন্যাশনাল ইয়ুথ ফেস্টিভ্যালে তিনি সরাসরি উপস্থিত তরুণদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন। এমন সময়ে একজন কর্মকর্তা নরেন্দ্র মোদির হাতে একটি চিরকুট তুলে দেন। এটি হাতে পেয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে তার বক্তৃতা বন্ধ করে দেন। উপস্থিত অতিথিদেরকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে নিজের কার্যালয়ে ছুটে যান তিনি। পিটিআই’র খবরে বলা হয়েছে, সকাল থেকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দেশের শীর্ষ নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ভিড় জমতে থাকে। তারা কাশ্মীরের পরিস্থিতি নরেন্দ্র মোদিকে বিস্তারিত খুলে বলেন। উপস্থিত নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন- জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তারা কাশ্মীরের পরিস্থিতি তুলে ধরে ভারতের করণীয় নিয়ে আলোচনা করেন। তবে ওই বৈঠকে কী সিদ্ধান্ত হয়েছে তা জানা যায় নি। গতকালের হামলার পর থেকে অনেকটাই নীরব রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভারতের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সংবাদ সম্মেলন ছাড়া আর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি কেউ।

প্রধানমন্ত্রী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে মন্তব্য করতে অভ্যস্ত হলেও এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তার টুইটার অ্যাকাউন্টে নতুন কোনো বক্তব্য প্রকাশ করা হয়নি। এদিকে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ভারতীয় বিমান বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে অভিযানে সমর্থন দিয়ে বলেছেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান নয়, বরং আত্মরক্ষার্থে বালাকোটে  জৈশ-ই-  মোহাম্মদের জঙ্গি ঘাঁটিতে বোমাবর্ষণ করেছে ভারত। তিনি বলেন, ভারতে ফের জঙ্গি হামলার ছক কষেছিল  জৈশ। আর তাই সেটা রুখতেই বিমান অভিযান চালানো হয়েছে। সেই সঙ্গে সুষমা আরো বলেছেন, ভারত উত্তেজনা প্রশমনের জন্য দায়িত্বশীল ও সংযত পথেই চলতে চাইছে।

শান্তি ও সংলাপের আহ্বান ইমরান খানের: কাশ্মীর সংকট নিয়ে গতকাল জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। টেলিভিশনে সরাসরি প্রচারিত ওই ভাষণে তিনি প্রতিবেশী ভারতের প্রতি শান্তির বার্তা দেন। সংলাপের মাধ্যমে সংকট সমাধানের আহ্বান জানান। পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী বলেন, দু’পক্ষের হাতে যে ধরনের অস্ত্র আছে, তা নিয়ে কোনো পক্ষেরই ভুল হিসাবের সুযোগ নেই। সে কারণে ভারতের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, তাদের যেন শুভবুদ্ধির উদয় হয়। বিচক্ষণতার সঙ্গে দু’দেশের মধ্যকার সংকট নিরসনের আহ্বান জানান তিনি।

আর পাল্টাপাল্টি হামলা চালানো অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি কারোরই নিয়ন্ত্রণে থাকবে না বলেও সতর্ক করেন ইমরান খান। গতকালের হামলার বিষয়ে তিনি বলেন, ওই হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল এই বার্তা দেয়া যে, তোমরা যদি আমাদের দেশে আসতে পারো, আমরাও একই কাজ করতে পারি। আমরা যা করেছি, তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল এটা বোঝানো। ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য পাকিস্তানি বিমান সীমান্তের ওপারে বেসামরিক অঞ্চলে আঘাত হেনেছে বলেও জানান তিনি। ইমরান খান বলেন, সীমান্ত অতিক্রম করে আমাদের ভূ-খণ্ডে প্রবেশ করার পর পাকিস্তানি বিমান বাহিনী তাদের দুইটি মিগ বিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছে। এ থেকে তাদের বোঝা উচিত যে, আমরা মেধা ব্যবহার করে বিচক্ষণতার সঙ্গে কাজ করি। যুদ্ধের ভয়াবহতার বিষয়েও ভারতকে সতর্ক করেন ইমরান খান। তিনি বলেন, সব যুদ্ধ ভুল হিসাবের কারণেই হয়েছে। কেউই জানে না এর শেষ কোথায়? তিনি আরো বলেন, আমরা ভারতকে বলেছিলাম যে, তোমরা একতরফাভাবে যদি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করো, তাহলে আমরা জবাব দিতে বাধ্য হবো। কিন্তু ভারত নিজেরাই বিচারক, জুরি আর জল্লাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।

বিমান চলাচল ব্যাহত: পাকিস্তানের আকাশসীমা পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। অপর পাশে ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় নয়টি বিমানবন্দর সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়। পরে এগুলো বিমান উড্ডয়ন-অবতরণের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যম। বিমান চলাচল পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ফ্লাইড রাডার বলেছে, আন্তর্জাতিক রুটে চলাচলকারী বিমানগুলো ওই এলাকা এড়িয়ে চলেছে। ভারতের দ্য ভিস্তারা এয়ারলাইন্স জানিয়েছে, ঐ অঞ্চলে সব ধরনের বিমান চলাচল স্থগিত করা হয়েছে।

দিল্লির পাকিস্তানি ডেপুটি হাইকমিশনারকে তলব: নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার সইদ হায়দার শাহকে ডেকে পাঠিয়েছে ভারত। ধারণা করা হচ্ছে, গতকালের  হামলার বিষয়ে পাক ডেপুটি হাইকমিশনারের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য চাওয়া হবে। এ ছাড়া, পাকিস্তানের হাতে ভারতীয় পাইলট বন্দির ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছেন বিরোধী দল কংগ্রেসের প্রধান রাহুল গান্ধী। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, আমাদের  একজন বীর পাইলট নিখোঁজ রয়েছেন। তার অক্ষত প্রত্যাবর্তন আশা করছি। এই কঠিন সময়ে  আমরা সশস্ত্র বাহিনীর পাশে আছি। এ ছাড়াও ভারতের অন্তত ২১টি রাজনৈতিক দল একটি বিবৃতিতে বর্তমান নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

সংযম দেখানোর আহ্বান আন্তর্জাতিক বিশ্বের: সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে ভারত ও পাকিস্তানকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়া। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ভারত ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেছেন। তিনি উভয়পক্ষকে নতুন কোনো সামরিক পদক্ষেপ এড়িয়ে চলতে বলেছেন। গতকাল এক বিবৃতিতে পম্পেও বলেন, উভয় মন্ত্রীকে বলেছি যে, আমরা ভারত ও পাকিস্তানের সংযম দেখানোকে উৎসাহিত করি।

একই সঙ্গে নতুন সামরিক ব্যবস্থা বাদ দিয়ে সরাসরি আলোচনাকে অগ্রাধিকার দিতে তিনি দু’দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এ ছাড়া, ভারত-পাকিস্তানকে সংযম দেখাতে বলেছে চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও রাশিয়া। এ বিবৃতিতে ক্রেমলিন বলেছে, যেসব সংবাদ আসছে তাতে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমরা পরিস্থিতি গভীরভাবে নজরদারি করছি। এবং অবশ্যই আমরা সব পক্ষকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানাচ্ছি। একই আহ্বান জানিয়েছে বৃটেন। আর উভয়পক্ষকে সংলাপে বসার কথা বলেছে জার্মানি।

ব্রেকিং নিউজ :
Shares