সেই নৃশংস হত্যাযজ্ঞ স্মরণে প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর পালন করা হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। শোকাবহ এ দিনে পরম শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় গোটা জাতি স্মরণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের। শপথ নেয় শোককে শক্তিতে পরিণত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সুখী-সমৃদ্ধ ও মর্যাদাশীল দেশ গড়ার মাধ্যমে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানি বাহিনীর এদেশীয় প্রধান দোসর আলবদর বাহীনির বিচারের মাধ্যমে সামন্য হলেও জাতি কলংক মুক্ত হলো
ফিনিক্স পাখির আয়ু নিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীরা বারবার ফিরে ফিরে আসেন বাঙালির মানসপটে। প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে প্রতিভাত হয় কবির সেই অমিয়বাণী ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ভয় নাই ওরে ভয় নাই/নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’ শোককে শক্তিতে পরিণত করে সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্নের অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে যথাযোগ্য মর্যাদায় এবারের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উদযাপন করবে জাতি।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই এ দেশের বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন ঘাতকদের হত্যাযজ্ঞের টার্গেট। ২৫ মার্চের কালরাতে এবং পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সুপরিকল্পিত উপায়ে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্নভাবে হত্যা করা হয়েছে বুদ্ধিজীবীদের। কারণ দেশ ও জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানরা ছিলেন সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের প্রতীক। পাকিস্তানি শাসক-শোষক চক্রের অন্যায়-অত্যাচার ও শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে তারা ছিলেন দিকনির্দেশক এবং সোচ্চারকণ্ঠ। তাদের মেধা ও মননে অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবিক মূল্যবোধ ছিল গভীরভাবে প্রোথিত। এই বোধ তারা ছড়িয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি স্তরে। তারা স্বপ্ন দেখতেন সুস্থ-সুন্দর সমাজের। একটি সুখী-সমৃদ্ধ ও শোষণমুক্ত প্রগতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা তারা লালন করতেন- তাদের কর্মে ও চিন্তায়। তাই এদেশের বুদ্ধিজীবীরা পরিণত হয়েছিলেন স্বাধীনতার শত্রুদের অন্যতম লক্ষ্যবস্তুতে।
দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পর বাংলাদেশের মানুষ যখন জাতীয় স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত তখনই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বর্বর উন্মত্ততায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি জাতির ওপর। সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে তারা শুরু করে নির্বিচারে গণহত্যা। এরই প্রেক্ষাপটে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মেজর জিয়া এর পরই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলার দামাল ছেলেরা অস্ত্র হাতে নেমে পড়ে শত্রু নিধনে। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে যেখানে পায় আক্রমণ করতে থাকে। এভাবেই কেটে যায় দীর্ঘ ৯টি মাস।
ডিসেম্বর মাসে এসে পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায় দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী। মুক্তিসেনারা ঘিরে ফেলে রাজধানী ঢাকাকে। পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা মেতে ওঠে বুদ্ধিজীবী হত্যার নির্মম খেলায়। দখলদার পাকিস্তানিরা মনে করেছিল যারা এ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, জাতির মননশক্তি তাদের হত্যা করতে পারলে বাঙালি জাতিকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়া সম্ভব। ফলে ৯ মাসের যুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র দুদিন আগে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসররা ঢাকায় মেধাবী ও সাহসী শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, লেখক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের রাতের আঁধারে তাদের নিজ নিজ বাসা থেকে একে একে ধরে এনে হত্যা করে। ভয়াবহ নির্যাতনের চিহ্নসহ তাদের লাশ পাওয়া যায় রায়েরবাজার ও মিরপুরের বধ্যভূমিতে।
১৯৭১ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন দার্শনিক ড. জিসি দেব, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীরুজ্জামান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ড. অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী, ড. গোলাম মোর্তজা, ড. মোহাম্মদ শফি, শহীদুল্লা কায়সার, সিরাজুদ্দীন হোসেন, নিজামুদ্দীন আহমেদ, খন্দকার আবু তালেব, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, শহীদ সাবের, নাজমুল হক, আলতাফ মাহমুদ, নূতন চন্দ্র সিংহ, রণদা প্রসাদ সাহা, আবুল খায়ের, রশীদুল হাসান, সিরাজুল হক খান, আবুল বাশার, ড. মুক্তাদির, ফজলুল মাহি, ড. সাদেক, ড. আমিনুদ্দিন, সায়ীদুল হাসান, সেলিনা পারভীনসহ আরো অনেকে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালালেও জুন-জুলাই মাসের দিকে শুরু হয় বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা ও তালিকা প্রণয়ন। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে এ নীলনকশার বাস্তবায়ন শুরু হলেও ১৪ ডিসেম্বর সবচেয়ে বেশি হত্যাযজ্ঞ চলে। এ কারণে ১৪ ডিসেম্বরকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
এবারের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত হচ্ছে ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে
বিজয়ের আনন্দকে সামনে রেখে জাতি আজ মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নির্মিত স্মৃতিসৌধ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা ও বেদনার সঙ্গে স্মরণ করবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের। সর্বত্রই আজ জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে এবং শোকের প্রতীক কালো পতাকা ওড়ানো হবে।
যথাযোগ্য মর্যাদায় আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনের লক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন ও পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, আলোচনা সভা, শোক র্যালি, কবিতা আবৃত্তি, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ জাতির উদ্দেশে পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন। এ ছাড়া ও রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের শীর্ষ নেতারাও বাণী দিয়েছেন। পৃথক পৃথক এসব বাণীতে তারা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন এবং তাদের আদর্শকে সমুন্নত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
দিবসটি পালন উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি, প্রধনামন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতাসহ রাজনৈতিক দলের নেতাদের বাণীতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার শান্তি কামনা ও তাদের শোকার্ত পরিবারবর্গের প্রতি সমবেদনা জানানো হয়েছে।
এমনি প্রেক্ষাপটে জাতি আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করছে যথাযোগ্য মর্যাদায় এবং নানা আনুষ্ঠানিকতায়। বুদ্ধিজীবী হত্যার এদেশীয় পরিকল্পনাকারী আলবদর রাজাকারদের ফাঁসির রায় কার্যকরের মাধ্যমে কলঙ্কমুক্ত হয়েছে বাংলা। দেশের প্রতিটি মানুষ আজ শপথ নেবে রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশের। অঙ্গীকার করবে হিংস্র শকুনের থাবা থেকে দৃঢ় প্রতিরোধের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের এই লগ্নে দেশবাসীর দৃপ্তপ্রত্যয়, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক সুখী-সমৃদ্ধ, মর্যাদাশীল বাংলাদেশ গড়ার।
কর্মসূচি : সকালে রাজধানীর মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে দিবসের কর্মসূচি শুরু হবে। সকাল ৮টা ৫ মিনিটে প্রথমে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং পরে ৮টা ১০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিরপুর শহীদ বুদ্বিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রীর নেতৃত্বে শহীদ পরিবারের সদস্য এবং মুক্তিযোদ্ধারা পুষ্পস্তবক অপর্ণ করবেন। এর পরেই বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সর্বস্তরের মানুষ স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মাধ্যমে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন।জ ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণ করার জন্য দলের সব শাখা ও তার সহযোগী, ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মী, সমর্থক, শুভানুধ্যায়ী এবং সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
এ ছাড়া জাতীয় পার্টি, বিএনপি, জাসদ, সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টি, ন্যাপ, গণতন্ত্রী পার্টি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ, মহিলা লীগ, যুবলীগ, যুব মহিলা লীগ, ছাত্র লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, উদীচী, খেলাঘর, ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠন শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
আপনার মতামত লিখুন :