যে মৃত্যুকে গিরে নির্মিতহতে পারে সিনেমা।


rafiq প্রকাশের সময় : অগাস্ট ৬, ২০১৯, ০৫:৪৩ / ৪৮৫
যে মৃত্যুকে গিরে নির্মিতহতে পারে সিনেমা।

বিডি সংবাদ একাত্তর ডেস্ক  আশা ছিল, ভালোবাসা ছিল/ আজ আশা নেই, ভালোবাসাও নেই/ এই সেই কৃষ্ণচূড়া, যার তলে দাঁড়িয়ে’। ‘আনন্দ আশ্রম’ সিনেমায় নায়িকা শর্মিলা ঠাকুরের মৃত্যুর পর নায়ক উত্তম কুমারের এই গান দর্শকদের যেমন কাঁদিয়েছে; সেই কান্নাকেও হার মানিয়েছে আবহাওয়াবিদ নাজমুল হকের কান্না। উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ায় অবস্থানরত আবহাওয়াবিদ নাজমুল হকের সন্তান-সম্ভাবা স্ত্রী শারমিন আক্তার শাপলা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গতকাল ইন্তেকাল করেছেন। স্ত্রীর মৃত্যুর সংবাদ শুনে বিদেশ ভূঁইয়ে নাজমুল হকের অবস্থা কেমন? নাজমুল হকেই পরিণতি কী সিনেমার বিয়োগাত্মক গল্পের চেয়ে কম মর্মস্পর্শী? গতকালই নাজমুল দেশের পথে রওয়ানা দিয়েছেন। আর ডেঙ্গু আক্রান্ত শারমিন আক্তার শাপলাকে সোহরাওয়াদী হাসপাতালে যে দেখাশোনা করতেন সেই ছোটভাই জুয়েল ডেঙ্গুকে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের ওই বেডে শুইয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

৭ বছর বয়সী ছেলে সাকিবকে সন্তান-সম্ভাবা স্ত্রী শারমিন আক্তার শাপলার কাছে রেখে নাজমূল হক প্রশিক্ষণের জন্য দক্ষিণ কোরিয়া যান। স্ত্রীকে ছোট ছেলে এবং নিজের দিকে খেয়াল রাখার পরামর্শ দিয়েই বিমানে উঠেন। চাকরি সূত্রে ঢাকায় থাকেন। বিদেশে থাকায় স্ত্রীকে যেন একাকীত্ব গ্রাস না করে সে জন্য না কাটে তাকে ৩০ জুলাই শ্বশুরবাড়ি জয়পুরহাটে পাঠিয়ে দেন। শারমিন আক্তার শাপলা গ্রামে বাবার বাড়িতে গিয়েই সর্দি জ্বরে আক্রান্ত হন। বমি শরীর দুর্বল মাথা ব্যথা অনুভব করেন। ভেতরে ভেতরে তার রক্তের প্লাটিলেট আর প্রেসার কমতে থাকে। ডাক্তার দেখানো ও পরীক্ষার পর ডেঙ্গু ধরা পড়ে। বাধ্য হয়েই উন্নত চিকিৎসার জন্য পরিবারের সদস্যরা জয়পুরহাট থেকে ঢাকা এনে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি করান। কিন্তু এ হাসপাতালে ভর্তি করেও বাঁচানো যায়নি ৮ মাসের সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূ শাপলাকে। জেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে যখন হাসপাতালের বেডে নিথর হয়ে ছিলেন তখন পরিবারের লোকজন বিদেশে অবস্থানরত স্বামী নাজমুল হককে জানাতে চেয়েছিলেন। স্বামীর টেনিং এ অসুবিধা হবে এবং বিদেশে চিন্তা-ভাবনা করবেন সে জন্য তাকে নিজের জ্বরের কথা জানাতে পর্যন্ত দেননি।

শারমিন আক্তার শাপলার দুলাইভাই আনিসুর রহমান লাশ নেয়ার জন্য হাসপাতালে দাঁড়িয়ে ছিলেন। চোখে পানি মুছতে মুছতে বললেন, গাইনি পরীক্ষায় জানা গিয়েছিল মেয়ে সন্তানের বাবা-মা হচ্ছেন নাজমুল-শাপলা। কারণ আগের সন্তান ছেলে। এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর আনন্দ ও হাসিখুশির শেষ ছিল না। তবে হঠাৎ ট্রেনিংয়ের সুযোগ পেয়ে স্ত্রী শাপলার অনুরোধেই বিদেশ যান নাজমুল হক। কারণ দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার বাংলাদেশে আবহাওয়াবিদদের উন্নত টেনিং পেশাগত কাজে উপড়ে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে কাজ করে। স্বামীর প্রমোশন হবে সে স্বপ্ন দেখতো স্ত্রী শাপলা। ডেঙ্গুতে আক্রান্তের পর যখন জীবন সংকটাপন্ন তখনও স্বামীকে অসুস্থতার খবর জানাতে দেননি শাপলা।

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে অসুস্থ শাপলা বলেছিলে, ওকে (স্বামী নাজমুল হক) জানালে দুশ্চিন্তা করবে। আমাকে যে ভালোবাসে ট্রেনিং ছেড়ে ফিরে আসতে পারে দেশে। তাহলে ওর অনেক দিনের প্রত্যাশার সুযোগটা নষ্ট হয়ে যাবে। আমার কিছু হবে না। কিন্তু শাপলা স্বামী-সন্তান সকলকে ছেড়ে চলেই গেল। শুধু কী শাপলা! সঙ্গে অনাগত শিশুটিও রয়ে গেলো অনাগতই। এর চেয়ে আর কষ্ট কী হতে পারে! আমরা নাজমুলকে কী জবাব দিবো ভেবে কূল পাচ্ছি না।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় গতকাল মৃত্যুবরণ করা শাপলার পারিবারের সদস্যরা জানান, ৯ বছর আগে জয়পুরহাট পৌর শহরের শান্তিনগর এলাকার মৃত আব্দুস সালামের মেয়ে শারমিন আক্তার শাপলার সঙ্গে নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার ননুজ গ্রামের নাজমুল হকের বিয়ে হয়। স্বামী নাজমুল হক বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের সহকারী পরিচালক। তাদের ৭ বছর বয়সী ছেলে সাকিব শেরেবাংলা বয়েজ স্কুলে ক্লাস ওয়ানে পড়ে।

২৯ জুলাই দক্ষিণ কোরিয়া যান নাজমুল হক। বিদেশ যাওয়ার পরদিনই ৩০ জুলাই জ্বরে আক্রান্ত হন শাপলা। ২ আগস্ট শুক্রবার দুপুরে শাপলাকে জয়পুরহাট জেলা আধুনিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হওয়ায় ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ও ডায়াবেটিস থাকার কারণে উন্নত চিকিৎসার জন্য ৩ আগস্ট শনিবার রাতে তাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। গতকাল সোমবার চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় মৃত্যু হয়।

জয়পুরহাটে অবস্থানরত শাপলার বড় ভাই জহুরুল ইসলাম উজ্জ্বল জানান, ছোট ভাই জুয়েল শাপলার অসুস্থতার কারণে শুরু থেকে বোনের সঙ্গেই ছিল। বড়বোনের মৃত্যুর মধ্যেই ছোট ভাই জুয়েলও জ্বরে আক্রান্ত হয়। পরীক্ষার পর জানা গেলো জুয়েলও ডেঙ্গু আক্রান্ত। সোহরাওয়ার্দীতে এখন ওর চিকিৎসা চলছে। আমরা বড় বোন শাপলার জানাজা-দাফন ব্যবস্থা করছি। এর চেয়ে আর কী কষ্ট হতে পারে? নাজমুলকে কি জবাব দেব? ৭ বছরের ছেলেটার কি হবে? এখনও ঘোরের মধ্যে আছি। তরতাজা হাসিখুশি বোনটা আমাদের মাঝে নেই, তা এখনও ভাবতেই পারছি না।

জহুরুল ইসলাম জানান, বিদেশে অবস্থানরত নাজমুল হককে স্ত্রী শাপলার মৃত্যুর খবর জানানো হয়েছে। রাতেই শাপলার স্বামী নাজমুল হক দক্ষিণ কোরিয়া থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওয়ানা দিয়েছেন। গতকাল জোহরের নামাজের পর শেরেবাংলানগরস্থ আবহাওয়া অধিদফতর অফিসে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ মঙ্গলবার নওগাঁয় ফিরে দ্বিতীয় নামাজে জানাজার পর শাপলার লাশ দাফন করা হবে।

জানতে চাইলে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের গাইনি অ্যান্ড অবস বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ফাতেমা আশরাফ সাংবাদিকদের বলেন, ক্রিটিক্যাল অবস্থায় এক অন্তঃসত্ত্বা রোগী আসছে এটা আগেই জেনেছিলাম। এ জন্য আমাদের প্রস্তুতিও ছিল। কিন্তু আমাদের এখানে ভর্তি করতে করতে বেশ দেরি হয়ে যায়। এখানে প্রথমে গাইনি ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হয়। অবস্থার অবনতি হলে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু তার ডেঙ্গু লাস্ট স্টেজে চলে গিয়েছিল। সঙ্গে ছিল ডায়াবেটিস ও শ্বাসকষ্ট। ডেঙ্গুর কারণে ইন্টারনাল বিøডিংও শুরু হয়। অনেক চেষ্টা করেছি, বাঁচাতে পারিনি। অন্তত অনাগত সন্তানকে বাঁচাতে পারলে মা হিসেবে আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম।

ব্রেকিং নিউজ :
Shares