মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধে লেভেল লাগিয়ে মেয়াদ বৃদ্ধি জীবন রক্ষার পরিবর্তে জীবন কেড়ে নেওয়া হচ্ছে : জেনেশুনে রোগীদের হত্যা, এটা হত্যার শামিল : মোবাইল কোর্ট


rafiq প্রকাশের সময় : জানুয়ারী ২৭, ২০১৯, ০৬:০২ / ২৫৬
মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধে লেভেল লাগিয়ে মেয়াদ বৃদ্ধি জীবন রক্ষার পরিবর্তে জীবন কেড়ে নেওয়া হচ্ছে : জেনেশুনে রোগীদের হত্যা, এটা হত্যার শামিল : মোবাইল কোর্ট

রফিক চৌধুরী—————————বিদেশ থেকে আসা মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধে সয়লাব হয়ে গেছে দেশের ওষুধের বাজার। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি করে মেয়াদ নিজেরাই বাড়িয়ে লেভেল বসিয়ে দেয় এক শ্রেণির ব্যবসায়ী। তারপর প্যাকেটর গায়ে নিজেদের ইচ্ছামতো মূল্য বসিয়ে দেয় তারা। ওষুধের প্যাকেটের গায়ে লাগানো নকল লেভেল আসল ভেবে কেনেন ক্রেতারা। স্বাস্থ্য অধিদফতর ও ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের সতর্কবার্তাতেও অসাধু ব্যবসায়ীদের এই অবৈধ বাণিজ্য বন্ধ হচ্ছে না। কিন্তু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার শিকার হচ্ছেন রোগীরা। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ খেয়ে অনেক রোগী অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। এসব ওষুধ ব্যবহারে আরোগ্য লাভের পরিবর্তে নতুন করে স্বাস্থ্যগত জটিলতায় পড়ছেন অনেকে।

বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলছেন, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম হুমকি। এসব ওষুধ জীবন রক্ষার পরিবর্তে জীবন কেড়ে নিচ্ছে। জেনেশুনে রোগীদের মৃত্যুর পথে ঠেলে দেওয়াটা হত্যাকা্লেরই শামিল বলে মনে করছে মোবাইল কোর্ট। এ জন্য জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে তারা।

জানা গেছে, দেশের বৃহত্তম ওষুধের মার্কেট ফিটফোর্ড বাবু বাজার এলাকায় পাইকারি বিদেশী মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ প্রকাশ্যে বিক্রি করা হচ্ছে। এসব ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ওষুধ প্রশাসনের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সংগঠনের এক শ্রেণীর নেতা প্রতিমাসে নির্ধারিত হারে মাসোহারা পেয়ে থাকেন। কয়েক জন ব্যবসায়ী ইত্তেফাকের কাছে এর সত্যতা স্বীকারও করেছেন। এক শ্রেণীর চিকিত্সকও অর্থের লোভে ভেজাল ওষুধ প্রেসক্রিপশনে উল্লেখ করে থাকেন। যে কারণে এসব ওষুধের এত চাহিদা।

সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে রাজধানী থেকে মফস্বলে এই মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ছড়িয়ে পড়েছে। এসব ওষুধ ক্যান্সার, হার্ট, কিডনি ও অপারেশনেও ব্যবহূত হচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রায় ১৬১ ধরণের মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের সন্ধান পেয়েছে মোবাইল কোর্ট। অনেক ওষুধ ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এসব ওষুধে নতুন করে ২০২০, ২০২১ সালের মেয়াদ লাগিয়ে দিয়ে বাজারজাত করছে মিটফোর্ড এলাকার ওষুধ ব্যবসায়ীসহ একটি সিন্ডিকেট।

সংশ্লিস্টরা জানান, বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোন দেশে এভাবে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ব্যবহূত হয় না। ওইসব দেশে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বাজারজাত করলে জড়িতদের শাস্তি হয় মৃত্যুদন্ড। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ এদেশে সীমান্ত ও আকাশপথে পাচার হয়ে আসছে ওই সংঘবদ্ধ চক্রের সহায়তায়। ওষুধ পাচারে বিমানবন্দরের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীও জড়িত। মেয়াদোত্তীর্ণ ও নিষিদ্ধ ওষুধ তারা প্রতি মাসেই জব্দ করে। কিন্তু সেসব ওষুধ কোথায় যায় তা ওষুধ প্রশাসন ও ওষুধ শিল্প সমিতি জানে না।

ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব সফিউজ্জামান বলেন, আমরা এসব ওষুধ নিয়ন্ত্রণের জন্য ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কাছে দাবি জানিয়ে আসছি। এসব অপকর্ম রোধে বিভিন্ন ধরনের দিকনির্দেশনাও আমাদের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। সীমান্ত ও আকাশ পথে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ আসছেই। বিমানবন্দরে এ ধরণের চালান ধরা পড়লেও তা ওষুধ প্রশাসনকে জানানো উচিত।

বিদেশে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার তিন মাস আগেই ওইসব ওষুধ বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়। কোন কোন দেশীয় কোম্পানিও বিদেশ থেকে এসব ওষুধ কিনে এনে মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়।

সূত্র জানায়, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ব্যবসার সিন্ডিকেটের সঙ্গে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। তারা অভিযান চালানোর আগেই তথ্য ফাঁস করে দেয়।

বিদেশ থেকে আনা মেয়াদোত্তীর্ণ উল্লেখ্যযোগ্য ২৪টি ওষুধ হলো— ট্যাবলেট সলোনেক্স ডিটি, ট্যাবলেট তোপাম্যাক ২৫, ট্যাবলেট কমবুতল ৪০০, ইনজেকশন দুরোন, ইনজেকশন প্যালাসেনটেক্স, ইনজেকশন কেপরিন, ট্যাবলেট সেলসেফট, ক্যাপসুল এক্সিলন, ক্যাপসুল প্রোজেক, ইনজেকশন ইপ্টইন, ইনজেকশন এডরিনল, ইনজেকশন মিটোমাইসিন, ইনজেকশন সেলপ্লাট ৫০, ইনজেকশন উইনোপম, ইনজেকশন ডোপাসেফ, ইনজেকশন মেটাডক্স, ইনজেকশন ডাইগক্সিন, ইনজেকশন জসিন, ইনজেকশন কভোরিন, ইনজেকশন জোভিরেক্স, ইনজেকশন সাইটোজেম, ইনজেকশন অকটেনাইন, ইনজেকশন এমিডভিন ও ইনজেকশন নানক্সল।

র্যাবের মোবাইল কোর্ট গত বছর মিটফোর্ড ওষুধের মার্কেটসহ সারাদেশে অভিযান চালিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বাজারজাত করার সঙ্গে জড়িত ৪৪৪ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছে। ৮২ কোটি টাকার ওষুধ জব্দ করা হয়েছে। জরিমানা করা হয়েছে ৬ কোটি, ৫৬ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকা। মামলা করা হয়েছে ৩৬৮টি। মোবাইল কোর্ট দেখতে পেয়েছে ঢাকার নামিদামি হাসপাতালগুলোও এ ধরনের মেয়াদোত্তীর্ণ বিদেশি ওষুধ ব্যবহার করছে। মোবাইল কোর্ট সেখান থেকেও ওষুধ জব্দ করেছে।

ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে মিটফোর্ড এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে আমরা অগ্রসর হচ্ছি। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ নিয়ে কোন ধরনের অনিয়ম বরদাশত করা হবে না।

বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়, যথাযথ মনিটরিং না থাকা এবং দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও এক শ্রেণীর চিকিত্সক জড়িত থাকায় মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সবখানে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।

ব্রেকিং নিউজ :
Shares