মার্চে উপজেলা নির্বাচন– বিএনপির তৃণমূলে ‘না’


rafiq প্রকাশের সময় : জানুয়ারী ১১, ২০১৯, ২১:০৯ / ২৪০
মার্চে উপজেলা নির্বাচন– বিএনপির তৃণমূলে ‘না’

রফিক চৌধুরী——————————- ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী দল বিএনপির। ২৯৯টি আসনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে মাত্র ৬টিতে বিজয়ী হয়েছেন দলটির প্রার্থীরা। আর তাদের জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা জয় পেয়েছে দুটি আসনে। জাতীয় নির্বাচনে এমন ভরাডুবিকে এখনো অবিশ্বাস্য মনে করছেন দলটির নীতিনির্ধারণী নেতারা। যদিও নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন তারা। জাতীয় নির্বাচনে বিপর্যয়ের এই ধাক্কা সামলাতে না সামলাতে ফের চলে এসেছে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। আগামী মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হবে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। তিনি বলেছেন, আগামী মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে ধাপে ধাপে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ করা হবে। ফলে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা, মনোনয়নপত্র জমা, প্রত্যাহার ইত্যাদি কার্যক্রম শুরু হবে ফেব্রুয়ারিতেই। এই নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন দল ফুরফুরে অবস্থানে থাকলেও দ্বিধান্বিত তাদের প্রতিদ্ব›দ্বী দল বিএনপি।
আসন্ন এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা উচিত কিনা? কিংবা অংশগ্রহণ করলে কি হবে সে বিষয়ে দ্বিধাবিভক্ত দলটির নেতা ও নীতিনির্ধারণীরা। দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এই নির্বাচন বর্জনের পক্ষে মতামত দিয়েছেন। তবে দলের ভেতরে নির্বাচনপন্থী হিসেবে পরিচিত একটি অংশ নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেছেন। তৃণমূলের নেতারা বলছেন, ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনই প্রমাণ করে দলীয় সরকার ও বর্তমান সিইসির অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, তত্ত¡াবধায়ক সরকারের যে দাবিটি বিএনপির ছিল তা বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে একবার প্রমাণিত হয়েছে। পরবর্তীতে তা চরম বাস্তব সত্য হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। ফলে নতুন করে এই দাবির যৌক্তিকতার কথা বলে নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে নেতাকর্মীরা আবারও হামলা-মামলার মুখে পড়বে। অন্যদিকে দলের আরেকটি অংশ উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে। তারা বলছেন, গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপিকে নির্বাচনে যাওয়া উচিত। তাহলে নির্বাচনের প্রকৃত চিত্র দেশবাসী ও বহির্বিশ্ব জানবে। নির্বাচনে গেলে সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির যে অভিযোগ, তা আরও মজবুত হবে বলেও মনে করেন তারা। তবে তফসিলের পর দলের নীতিনির্ধারকরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।
উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে কিনা জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে ভোট ডাকাতির মহোৎসব হলো সেই আতঙ্কজনক পরিবেশই এখনো কাটেনি। আমরা এখনো উপজেলা নির্বাচনের বিষয়ে কোন আলোচনাই করিনি। কিছুদিন যাক, সময় হলে দলের সকলে মিলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব এড. রুহুল কবির রিজভী বলেন, উপজেলা নির্বাচন ইস্যুতে এখনো আলোচনা করা হয়নি। আশা করি দলের নীতিনির্ধারণী নেতারা যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। কোনটি করলে ভালো হবে সেটা তারা আলোচনা করে ঠিক করবেন।
দলের তৃণমূলের নেতাদের অনেকের সাথে কথা বলে জানা যায়, মাঠপর্যায়ে দলের সক্রিয় নেতাকর্মীদের সবার বিরুদ্ধেই মামলা রয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী কারাগারে আটক রয়েছেন। যারা বাইরে রয়েছেন তারাও গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। দফায় দফায় হামলা, পালিয়ে থাকার কারণে আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত অনেক নেতাকর্মী। জাতীয় নির্বাচনেও তারা ভোট কেন্দ্রে যেতে পারেননি। এই অবস্থায় উপজেলা নির্বাচনে যেতে চাইলে নেতাকর্মীরা সক্রিয়ভাবে মাঠে নামতে পারবেন না। তাছাড়া সরকার সংসদ নির্বাচনের মতোই সর্বশক্তি দিয়ে উপজেলা নির্বাচনেও জোর করে বিজয় ছিনিয়ে নেবে। এ ধরনের নির্বাচনে যাওয়ার চেয়ে বর্জন করা দল এবং নেতাকর্মীদের জন্য মঙ্গলজনক।
বিএনপির সিলেট বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক দিলদার হোসেন সেলিম বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরই প্রমাণিত হয়েছে এই সরকারের অধীনে নির্বাচন কি ভয়ংকর হতে পারে। ফলে এই সরকারের অধীনে আর নতুন কোন নির্বাচনে যাওয়ার প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করেন না।
নেত্রকোণা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ডা. মোঃ আনোয়ারুল হক বলেন, এই সরকারের অধীনে নতুন কোন নির্বাচনে গিয়ে নেতাকর্মীদের বিপদে ফেলা ঠিক হবে না। কারণ ইতোমধ্যে সমস্ত নেতাকর্মী হামলা, মামলায় জর্জরিত। এই অবস্থায় নির্বাচনের পরিবর্তে তাদেরকে মুক্ত করা এবং দলকে সুসংগঠিত করা উচিত।
যশোর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এড. সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু বলেন, জাতীয় নির্বাচনে সরকার রাতের ভোটের যে সংস্কৃতি চালু করেছে তা উপজেলা নির্বাচনেও প্রয়োগ করবে। বরং এই নির্বাচনে যে ভুল তারা করেছে উপজেলাতে তা আরও সুচারুরূপে প্রয়োগ করবে। ফলে এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়া মানে নিশ্চিত পরাজয় জেনেই অংশ নিতে হবে। তাই এখন দলকে সংগঠিত করা এবং বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে দলকে মাঠে নামতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, দলের ভেতরে নির্বাচনপন্থী হিসেবে যারা পরিচিত তারাও এখন হতাশ হয়ে পড়েছেন। কারণ সরকার এমন এক নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু করেছে যেখানে তারা প্রতিদ্ব›িদ্বতা চায় না, প্রতিপক্ষ চায় না। নির্বাচনের কোন পরিবেশই নাই। আবার এখন দলের অস্তিত্ব রক্ষা, গণতন্ত্র রক্ষা, গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখা ইত্যাদি বলাও অর্থহীন। তারপরও দল, ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দল যদি মনে করে নির্বাচনে যাবে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। তবে প্রশ্ন দেখা দেবে এই নির্বাচন কমিশন ও সরকারের অধীনে ভাল নির্বাচন কিভাবে আদায় করবে? নাকি আবারও নির্বাচন নির্বাচন খেলা, নির্বাচনের নামে ভন্ডামি আর তামাশা হবে। তবে সরকার ও নির্বাচন কমিশন যদি অতীতের নির্লজ্জ নির্বাচনের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চায় তাহলে দল নির্বাচনে যেতে পারে বলেও মতামত দেন তিনি।
তবে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলে ক্ষমতাসীন দল ভোট ডাকাতি করেছে তা আমরা বলতে পারতাম না। আমার ব্যক্তিগত মতামত- গণতান্ত্রিক দল হিসেবে উপজেলা নির্বাচনে যাওয়া উচিত। এ নির্বাচনে অংশ নিয়ে আমরা ক্ষমতাসীন দল ও সিইসির চেহারা আবারও দেশবাসীকে দেখাতে চাই। তবে নির্বাচনে যাওয়া না-যাওয়ার বিষয়টি কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল নেতাদের মতামত নিয়েই দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হবে।
এদিকে বিএনপি সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার বিকালে নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের প্রথমবারের মতো বিএনপির সাংগঠনিক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকদের অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়। বৈঠকে তাদের সাথে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান স্কাইপিতে যুক্ত হন। বৈঠকে উপস্থিত এক নেতা জানান, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পরবর্তী করণীয় নিয়ে তাদের মতামত চান। একইসাথে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কী করা যায় সে বিষয়েও জানতে চান। উপস্থিত নেতারা বলেছেন, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনকে ভোট ডাকাতির নির্বাচন বলছি। এখন যদি সেই সিইসির অধীনেই উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেই, তাহলে বিশ্বাযোগ্যতা নষ্ট হবে। এ ছাড়া নেতাকর্মীদেরও নতুন করে হামলা-মামলার মুখে ফেলতে চাই না।
সর্বশেষ ২০১৪ সালে ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম ধাপে ৯৭ উপজেলায় নির্বাচন হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় ধাপে ১১৭ উপজেলায় ভোট হয়। ওই বছর সব মিলিয়ে ৭ ধাপে ভোট হয়। তবে গতবার নির্দলীয়ভাবে উপজেলা নির্বাচনে ভোট হলেও এবার হবে দলীয় প্রতীকে। আগামী মার্চে দুই থেকে তিন ধাপে ভোট গ্রহণের বার্তা দিয়েছে ইসি। সেই আলোকে এ মাসের শেষ বা আগামী মাসের শুরুতে তফসিল হতে পারে।

ব্রেকিং নিউজ :
Shares