ভোট সুন্দর হয়েছে সিইসি-বিজয়ী ঘোষণা  নৌকা প্রার্থী তাপস আতিক দু’জনকেই।


rafiq প্রকাশের সময় : ফেব্রুয়ারী ২, ২০২০, ০৭:৪৫ / ২৪৯
ভোট সুন্দর হয়েছে সিইসি-বিজয়ী ঘোষণা  নৌকা প্রার্থী তাপস আতিক দু’জনকেই।

বিডি সংবাদ একাত্তর  স্টাফ রিপোর্টার

ভোট সুন্দর হয়েছে সিইসি-বিজয়ী ঘোষণা  নৌকা প্রার্থী তাপস আতিক দু’জনকেই। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বিরাট সাফল্য পেয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়রপ্রার্থী মো. আতিকুল ইসলাম ও ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস। নৌকা প্রতীকের এই দুই প্রার্থী প্রতিদ্বদ্বীদের বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে বিজয়ী হয়েছেন। এর আগে দিনভর বিএনপি প্রার্থীদের অভিযোগ, ইভিএম বিভ্রাট, ইভিএম ব্যবহারের পদ্ধতি দেখিয়ে দেয়ার নাম করে ভোটারের ভোট দিয়ে ফেলা, প্রকাশ্যে ভোট দিতে বাধ্য করা, সাংবাদিকদের ওপর হামলা, এজেন্ট ঢুকতে না দেয়া, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়াসহ নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে দুই সিটি করপোরেশনের ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়। ইভিএম মেশিনে ভোট গ্রহণের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই কম। ইভিএম নিয়ে সন্দেহ-বিতর্কের মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ভোট দিতে গিয়ে ইভিএম ত্রুটির মুখে পড়েন। অতঃপর নির্বাচনের চিত্র দেখে সিইসি বলেন, ‘ঢাকা দুই সিটিতে এমন নির্বাচন চাইনি’। তবে বিকেলে ইসির জরুরি বৈঠকের পর সিইসি জানান, ভোট সুন্দর হয়েছে তবে শতকরা ৩০ ভাগের বেশি ভোট পড়েনি। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, ইভিএমের ভোট গ্রহণ করে শতভাগ ভোট পড়ার অপবাদ থেকে আমরা মুক্ত হয়েছি। তবে ২৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি।

ভোট গণণার পর ঢাকা উত্তর সিটিতে মো. আতিকুল ইসলামকে বেসরকারিভাবে মেয়র নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি পেয়েছেন ৩,৭০,০৬১ ভোট (১০৬৫ কেন্দ্রে)। তার নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বী বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী তাবিথ আউয়াল। তিনি ভোট পেয়েছেন ২,১২,৫৭৭। ঢাকা দক্ষিণে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। তিনি পেয়েছেন ৪,২৪,৫৯৫ ভোট। আর তার নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বী বিএনপি মনোনীত ধানের শীষ ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন পেয়েছেন ২৩৬,৫১২ ভোট। অন্যান্য দলের মেয়র প্রার্থীদের কেউ উল্লেখ করার মতো ভোট পাননি। বিভিন্ন ওয়ার্ডের কমিশনার ও সংরক্ষিত মহিলা আসনের নির্বাচিত কমিশনারদের ফলাফল আজ রোববার বেলা ১১টায় ঘোষণা করা হবে।
দলের দুই প্রার্থীকে বেসরকারিভাবে মেয়র নির্বাচিত ঘোষণার পর নতুন দুই মেয়রের কর্মী-সমর্থকরা উল্লাস করেন। তারা বিজয় মিছিল এবং মিষ্টি বিতরণ করেন। এ সময় আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা উপস্থিত ছিলেন। রাতেই আতিকুল ইলাম ও ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) প্রথম ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে নির্বাচন হলো। সকাল ৮টায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে চলে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। দুই সিটিতে ভোটকেন্দ্র ছিল দুই হাজার ৪৬৮টি। ভোটকক্ষ ছিল ১৪ হাজার ৪৩৪টি। ঢাকা উত্তর সিটিতে এক হাজার ৩১৮টি ভোটকেন্দ্র ও সাত হাজার ৮৫৭টি ভোটকক্ষ এবং দক্ষিণ সিটিতে এক হাজার ১৫০টি ভোটকেন্দ্র ও ছয় হাজার ৫৮৮টি ভোটকক্ষে ভোট গ্রহণ করা হয়। ২৮ হাজার ৮৭৮টি ইভিএমের মাধ্যমে এই ভোটগ্রহণ করা হলেও অনেক কেন্দ্রে ইভিএম মেশিনে ত্রæটির কারণে ভোট গ্রহণে ব্যাঘাত ঘটে। দুই সিটিতেই ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই কম। নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ও কমিশনার প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের উপস্থিতি দেখা গেলেও ধানের শীষ প্রতীকের কর্মী-সমর্থকদের তেমন উপস্থিতি দেখা যায়নি। বিএনপির মেয়র প্রার্থীরা অভিযোগ করেছেন তাদের পোলিং এজেন্টদের অনেক কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। অনেক কেন্দ্র থেকে পোলিং এজেন্টদের জোর করে বের করে দেয়া হয়েছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও ভোট গ্রহণকারীরা তা নীরব দর্শকের মতো দেখেছেন। নির্বাচনে ভোট গ্রহণ নিয়ে অভিযোগ ছিল বিস্তর। সব অভিযোগই বিএনপির মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা করেছেন। তবে কিছু ভোটার ইভিএমের কারণে ভোট দিতে পারেননি বলে অভিযোগ তুলেছেন। ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণের দুই শতাধিক কেন্দ্রে সরেজমিন ঘুরেও নানা অনিয়মের চিত্র দেখা গেছে। ঢাকার বহু কেন্দ্রে বিএনপির মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের এজেন্টদের ঢুকতে দেয়া হয়নি। কেন্দ্রের আশপাশে বিএনপির কর্মীদের উপস্থিতিও ছিল না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থীদের কর্মীরা জানিয়েছেন, বিএনপির মেয়র প্রার্থীর কর্মীরা ভোটকেন্দ্রে না এলে তাদের করার কিছু নেই। তবে নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থীদের পক্ষে বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মীর উপস্থিতি ছিল সর্বত্র। কেন্দ্রের ভেতরে-বাইরে সব জায়গা ছিল তাদেরই নিয়ন্ত্রণে।
ইভিএম বিড়ম্বনা : ঢাকার দুই সিটিতে ৫৪ লাখেরও বেশি ভোটার। প্রথমবারে মতো বিপুল সংখ্যক এই ভোটারের একযোগে ইভিএম-এ ভোটগ্রহণ করা হয়। কিন্তু এই সিস্টেমে খুব অল্প সংখ্যক ভোটারই তাদের ভোট প্রয়োগ করে সন্তোষ প্রকাশ করছেন। আঙুলের ছাপ মিলছে না, মেশিন কাজ করছে না, কোথাও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দীর্ঘক্ষণ ভোটগ্রহণ বন্ধ ছিল। এমন বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা। বিড়ম্বনার শিকার হন ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনও। এই পদ্ধতিতে ভোট দেয়ার সময় গোপনীয়তাও রক্ষা হচ্ছে না বলে অভিযোগ অনেকের।
তেজগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, ইভিএমএ তার ফিঙ্গার নিয়ে পোলিং এজেন্ট বলে সময় নেই চলে যান। আমি ভোট দিয়ে দিচ্ছি। এছাড়া ফিঙ্গারপ্রিন্ট না মেলায় এ কেন্দ্রে ভোট দিতে পারেননি একাধিক ভোটার। রাজধানীর উত্তরা ৫ নম্বর সেক্টরের আই ই এস স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে ভোট দিতে যান সিইসি। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট দিতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েন তিনি। ফিঙ্গার মেলেনি তার। পরে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি কার্ড) দেখিয়ে নিজের ভোট দেন।
সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে রাজধানীর ভিকারুননিসা স্কুল এন্ড কলেজ কেন্দ্রে ভোট দেয়ার পর ড. কামাল হোসেন বলেন, ইভিএম অনেক জটিল প্রক্রিয়া। আমার ভোটার নাম্বার বের করতে আধাঘন্টা সময় লেগেছে। দিতে লেগেছে ১০ মিনিট। আমার আধা ঘণ্টা সময় লেগেছে অন্য ভোটাররা ধৈর্য ধরে ভোট দিতে পারবে কিনা সেটাই দেখার বিষয়। গুলশান-২ এর মডেল স্কুল এন্ড কলেজ কেন্দ্রে ভোট দিতে গিয়ে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহামুদুর রহমান মান্না বলেন, আমি ইভিএমে বোতাম চাপ দিলাম, কোথায় ভোট গেল কীভাবে বুঝবো। এই ভোটে জনগণের ইচ্ছার কোন প্রতিপলন হবে বলে আস্থা রাখা যায় না। বয়স্ক ও শ্রমজীবী মানুষের ইভিএমে ভোট দিতে বেশি অসুবিধা হচ্ছে। অনেকবার চেষ্টা করার পরও অনেকের আঙুলের ছাপ মিলছে না।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মিরপুর উদয়ন উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ইউসুফ আলী সকাল ৮টায় ভোটকক্ষ ৫-এ ভোট দিতে আসেন। পেশায় ঝালমুড়ি বিক্রেতা ইউসুফ কয়েকবার চেষ্টা করার পরও ভোট দিতে পারেননি। পরে আবার বেলা সাড়ে ১১টায় আসেন। তখনো ফিঙ্গার প্রিন্ট না মেলায় সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের সহায়তায় ভোট দেন তিনি। ওই কক্ষে মোট ভোটার সংখ্যা ৩৬৭। বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ভোট পড়ে ৫৩টি। এর মধ্যে ৪ জন প্রিসাইডিং অফিসারের সহায়তায় ভোট দেন। এছাড়া আরও ৫ জনকে হাত ধুয়ে আবার আসতে বলা হয়েছে। এই কেন্দ্রের অন্য বুথেও এমন অবস্থা। হক পেদা (৫৩) ঝুটের কারখানায় কাজ করেন। তিনিও একই সমস্যায় পড়েছেন। মিরপুর আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ৭৩ বছর বয়সী এক নারী ফিঙ্গার প্রিন্ট না মেলায় ভোট না দিয়েই চলে যেতে বাধ্য হন। তিনি বলেন, এত ভোট দিছি। কোনো দিন এমন হয়নি। এহন বুড়া বয়সে ভোট দিতে পারলাম না।
দিনভর ভোটের খন্ডচিত্র : ঢাকা দক্ষিণ সিটির মাদারটেক আব্দুল আজিজ স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভোটারদের জোর করে নৌকা প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করা, ধানের শীষের এজেন্টদের বের করে দেয়া, ভোট দেয়ার সময় গোপন বুথে ভোটারদের সাথে দাঁড়িয়ে থাকার অভিযোগ করা হয়। ওই কেন্দ্রের কয়েকজন নারী অভিযোগ করে বলেন, ভোট দিতে বুথে ঢোকার পর নৌকার এজেন্টরা পেছনে দাঁড়িয়ে থাকেন এবং নৌকা প্রতীকে ভোট দেয়ার জন্য জোর করেন। আবার যারা নৌকা প্রতীকে ভোট দেবে না বলে মনে হয় তাদের ফিঙ্গার প্রিন্ট রেখে বের করে দেয়া হয়। সরেজমিনে ওই কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, কেন্দ্রের ভেতরের মাঠে ভোটারও বিভিন্ন প্রার্থীর নেতা-কর্মীরা অবস্থান নেন। ভোটারদের সরকার দলীয় প্রার্থীদের কর্মীরা বুথে নিয়ে যাচ্ছেন পাশে থেকে দেখছেন কে কোথায় ভোট দিচ্ছে। কেউ তাদের কথামতো ভোট দিতে না চাইলে বের করে দেয়া হয়। এ সময় কয়েকজন সাংবাদিক দেখে বেশ কয়েকজন মহিলা ভোটার তাদের কাছে ভোট নিয়ে নানা অভিযোগ করেন এবং তাদের অভিযোগেরও সত্যতা পাওয়া যায়। এ সময় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীর ওপর হামলা করলে ছবি তোলার সময় কয়েকজন সাংবাদিকের ক্যামেরা ও মোবাইল কেড়ে নেয় এবং নির্বাচন কমিশনের দেয়া কার্ডও কেড়ে নেয় তারা।
ঢাকা উত্তর সিটিতে ১৬ নং ওয়ার্ডে উত্তর কাফরুল উচ্চ বিদ্যালয়ে গতকাল বিকেলে আওয়ামী লীগের একজন পোলিং এজেন্টের বিরুদ্ধে জোর করে নৌকা প্রতীকে ভোট দেয়ার অভিযোগ করেন কয়েকজন নারী ভোটার। ওই ওয়ার্ডে আমেনা খাতুন নামে একজন প্রার্থী অভিযোগ করে বলেন, ইভিএমে মেয়র পদে নৌকা, কাউন্সিলর পদে ব্যাডমিন্টন ও মহিলা কাউন্সিলর পদে আনারস প্রতীক তিনটি সেট করে রাখা হয়েছে। আবার বুথে ঢুকে নৌকা প্রতীকের এজেন্টরা ভোট দিতে বলে তাদের প্রতীকে। বুথে কেন জিজ্ঞেস করলে বলে শিখিয়ে দিচ্ছি। আরেকটি বুথে গিয়ে দেখেছি ফিঙ্গার প্রিন্ট নেয়ার পর একটি করে মার্কা রয়েছে। অভিযোগ করার পর আফরোজা নামে আওয়ামী লীগের একজন মহিলা ঠিক করে দেয়। সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার শামসুল হকের কাছে অভিযোগ করা হলেও তিনি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।
ওই কেন্দ্রে কয়েকজন নারী ভোটার অভিযোগ করে বলেন, তাদের ফিঙ্গার প্রিন্ট নেয়ার পর অন্যরা গিয়ে ভোট দিয়ে দিয়েছে। তাদের একজন বলেন, আমি ফিঙ্গার প্রিন্ট দেয়ার পরপরই একজন ছেলে এসে জোর করে আমার ভোটটা সে দিয়ে দিয়েছে। তাহলে আমি ভোট কেন্দ্রে কেন এসেছি? এসব নাটকের কোনো প্রয়োজন ছিল? মর্জিনা নামে আরেকজন মহিলা ভোটার বলেন, আমি ভোট দিতে ঢোকার পরপরই নৌকার এজেন্ট জিজ্ঞেস করে আমি কোন প্রতীকে ভোট দেবো? এরপর আমার ভোট উনি নৌকা ও আনারস মার্কায় নিজেই দিয়ে দিয়েছে এবং বলে আপনার ভোট হয়ে গেছে। ওই কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থীর এজেন্ট পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে ওই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার ভূপেন রঞ্জন রায় বলেন, আমার নলেজে এমন কোনো বিষয় নেই। এমন কিছু ঘটেনি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কার্জন হল কেন্দ্রে ধানের শীষে ভোট দেয়ায় এক ব্যক্তিকে মারধর করে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। শনিবার সকাল সোয়া ১০টার দিকে কার্জন হলের সামনে এ ঘটনা ঘটে। ওই ব্যক্তি ভোট দিয়ে বের হওয়ার পর বাইরে থাকা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁর কাছে জানতে চান, তিনি কোন প্রতীকে ভোট দিয়েছেন। ওই ব্যক্তি ধানের শীষে ভোট দিয়েছেন বলতেই তাঁকে মারধর শুরু করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে শনিবার বেলা ১টার দিকে ভোট দিতে এসেছিলেন এক ব্যক্তি। কিছুক্ষণ পরে বুথ থেকে বের হয়েই চিৎকার শুরু করেন তিনি। অল্প সময়ের মধ্যে তাঁকে ঘিরে কিছু মানুষ জড়ো হলো। জানা গেল, ওই ব্যক্তি ভোট দেয়ার সব কাজ করেছেন, জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে আঙুলের ছাপও দিয়েছিলেন। তবে ভোট দেয়ার বাটনে চাপ দিতে পারেননি, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তি বাটন চাপ দিয়ে তার ভোট দিয়ে দিয়েছেন। এমন কাজে হতবাক তিনি, বের হয়ে এসে অভিযোগ করতে থাকেন। সংসদ ভবনের উল্টো দিকে রাজধানী স্কুলে প্রকাশ্যে ভোট দিতে বাধ্য করা হচ্ছে বলে জানান দু’জন ভোটার। তাদের অভিযোগ সব প্রক্রিয়া শেষ করার পর বাটন চাপার সময় অন্য ব্যক্তি এসে ভোটারদের একটি প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করেন। ওই দু’জন ভোটার জানান, এটা দেখে তারা ভোট না দিয়েই চলে এসেছেন।
উত্তর সিটির ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের একটি ভোটকেন্দ্রে ভোটারের সঙ্গে বুথের গোপন কক্ষে ঢুকছেন প্রার্থীর এজেন্টও। তবে এ বিষয়ে দায়িত্বরত প্রিজাইডিং কর্মকর্তা বলেছেন, কেউ তাকে অভিযোগ করেনি। রাজাবাজারের নাজনীন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে নারীদের একটি কক্ষে এক নারী ভোটারকে ভোট দেয়ার উপায় বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন দায়িত্বরত পোলিং কর্মকর্তা। তার সঙ্গে দাঁড়িয়েছিলেন নৌকা ও লাটিম মার্কার এক নারী এজেন্ট। তিনি প্রথমে ভোটারের সঙ্গে গোপন কক্ষে ঢুকতে গেলে আরেক এজেন্ট সাংবাদিকের উপস্থিতি টের পেয়ে ইশারায় নিষেধ করেন। পরে ভোটার ভোটকক্ষে ঢুকলে ওই নারী এজেন্ট ভেতরে যান। এ বিষয়ে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের জিজ্ঞেস করলে বলেন, ভোটার সাহায্যের জন্য ডেকেছেন। কিন্তু সাহায্যের জন্য পোলিং এজেন্ট বা সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা না গিয়ে প্রার্থীর এজেন্ট কেন ঢুকলেন, জানতে চাইলে তারা কোনো উত্তর দেননি। ওই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা ফজলে রাব্বিকে জিজ্ঞেস করা হলে বলেন, কেউ তো এসে অভিযোগ করেনি। আর আপনারা তো সবই জানেন।
ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএমে) ভোট দেয়ার পদ্ধতি বোঝানোর নামে ভোটারদের সঙ্গে ভোটের গোপন কক্ষে ঢুকে পড়েন সরকারদলীয় মেয়রপ্রার্থী বা সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর কর্মী। ভোটার কিসে ভোট দিচ্ছেন, সেটাও তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন। শনিবার উত্তর সিটির নির্বাচনে উত্তরা গার্লস হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুইটি কেন্দ্রে এমন চিত্র দেখা গেছে। খাদিজা নাজনীন নামের এক নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদের আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আফসার উদ্দিন খানের কর্মী খুর্শিদা জাহান নামের এক ভোটারকে বুথের পর্দা ঘেরা ভোট দেয়ার স্থান পর্যন্ত নিয়ে যান। এই কর্মী ভোটার ভোট দেয়ার সময়ও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ভোট শেষে খুর্শিদা জাহান বলেন, ওই নারী (খাদিজা নাজনীন) আমার পেছন পেছনে হেঁটে আমার ভোটকক্ষ পর্যন্ত চলে আসেন। তিনি আমাকে বারবার বলছিলেন নৌকায় ভোট দেবেন। ভোট দেয়ার সময়ে নৌকা প্রতীকের বোতামে চাপ দিতে বলেন। আমি তাকে বারবার বলছিলাম আপনি চলে যান। কিন্তু তিনি পুরোপুরি গোপন কক্ষ থেকে বের হননি, দাঁড়িয়েছিলেন। এ ব্যাপারে খাদিজা নাজনীন বলেন, কেউ বুঝতে না পারলে, তাকে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য এখানে আছি। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে আরেকজন নারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তিনি ভোট দেয়ার সময় আওয়ামী লীগের দলীয় একজন কর্মী উপস্থিত ছিলেন। তিনি বারবার চলে যেতে বললেও যাননি এবং তিনি কোথায় ভোট দিয়েছেন, তা দেখেছেন। দ্বিতীয় তলার পুরুষ ভোটার কেন্দ্রেও এমন চিত্র দেখা যায়। কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা জাকির হোসেন বলেন, যারা বুঝতে পারছেন না, তাদের বোঝানোর জন্য এই ‘ডেমো যন্ত্রটি’ রেখেছি। তবে প্রতীকসহ ডেমো যন্ত্রটির ছবি তুলতে দেননি তিনি। সেটি আরেকটি বাক্সে ঢুকিয়ে ফেলেন।
সংঘাতের চিত্র : ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থীদের মহরাতে জমজমাট ছিল নির্বাচন। কেন্দ্রের সামনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের কর্মীরা সকাল থেকে ভোটার স্লিপ দিয়েছেন এবং শোডাউন করেছেন। বিএনপির কর্মীদের কেন্দ্রের সামনে দেখা যায়। বিএনপি পোলিং এজেন্ট সকালে কেন্দ্রে ঢুকতে চাইলেও যেসব ওয়ার্ডে বিএনপি শক্ত অবস্থানে ছিল সেখানে পোলিং এজেন্টদের ঢুকতে দেয়া হয়নি।
যেসব ওয়ার্ডে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিল সেখানেই গোলযোগের ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা উত্তর সিটির ১ নং ওয়ার্ডে বিএনপির প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমানকে মারধর করেছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আফছার উদ্দিন খানের কর্মীরা। এছাড়া পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে কেন্দ্র থেকে। নির্বাচনে আফসার উদ্দিন খান বিজয়ী হয়েছেন।
ঢাকা উত্তরের ৪৮ নং ওয়ার্ডে বিএনপির প্রার্থী আলী আকবর আলীর অভিযোগ, তার পোলিং এজেন্টদের কয়েক দফায় মারধর করে কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মাসুদুজ্জামান মিঠুর কর্মীরা। কিন্তু দিন শেষে আলী আকবর নির্বাচিত হয়েছেন। ৪৯ নং ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আনিছুর রহমান নাঈমের সঙ্গে দিনভর উত্তেজনা ছিল দলের প্রার্থী সফিউদ্দিন মোল্লা পনুর সমর্থকদের। নাঈম নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের আলোচিত কাউন্সিলর প্রার্থী আলেয়া সারোয়ার ডেইজি মারধরের শিকার হয়েছেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় ভোটকেন্দ্রের সামনে শনিবার বিএনপি প্রার্থী সেন্টুর কর্মীদের হামলার শিকার হন তিনি। এ সময় তার পরিধেয় কামিজও ছিঁড়ে ফেলা হয় বলে জানা গেছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী মুন্সি কামরুজ্জামান কাজলের ওপর আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী আবুল বাশারের সমর্থকদের হামলার ঘটনা ঘটেছে। গতকাল বিকালে ভিকারুন্নিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রের ভেতরে কাজলের ওপর হামলা চালানো হয়। এ সময় বাধা দিতে গেলে তার ছেলেকেও পেটানো হয়।
১২ নং ওয়ার্ডে নিজের ভোট দিতে গিয়ে প্রতীক দেখা না যাওয়ায় ক্ষুব্ধ হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী গোলাম আশরাফ তালুকদার। প্রায় ২ ঘণ্টা আবুজর গিফারি কলেজে নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাগি¦তন্ডা করেন তিনি। এছাড়া কয়েকটি কেন্দ্রে অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীর নিয়ে প্রবেশ করলে প্রিজাইডিং অফিসার সতর্ক করেন তাকে। সে সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, কেউই নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলে না, আর নির্বাচন কমিশনও ব্যবস্থা নেয় না। তাই এ নিয়ে তেমন চিন্তা করছেন না তিনি। এ ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী মামুন রশিদ শুভ্র জয়ী হয়েছেন।
৯ নং ওয়ার্ডে দিনভর ছিল উত্তেজনা। সাবেক কমিশনার মমিনুল হক সাঈদের (ক্যাসিনো সাঈদ) স্ত্রী ফারহানা ইসলাম বৈশাখীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোজাম্মেল হকের কর্মীদের উত্তেজনা ছিল। এ ওয়ার্ডে ১০৭ বছর বয়সী আলিমুজ্জমান নাতীর কাঁধে ভর দিয়ে ভোট দিয়েছেন ফকিরাপুলের ওয়াসা অফিস কেন্দ্রে। এখানে মোজাম্মেল হক জয়ী হয়েছেন।
ভয়ভীতির অভিযোগ : প্রথমবারের মতো ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট নেয়া হয়েছে ঢাকার দুই সিটিতে। বেশিরভাগ কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই কম। কিছু কেন্দ্রে ভোটার ছিল না বললেই চলে। নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারীদের অলস সময় পার করতে দেখা গেছে বিভিন্ন কেন্দ্রে। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ভোটাররা নিজেদের ইচ্ছামতো সিলেকশন ও কনফার্ম ভোটের বাটন চাপতে পারলেও তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী ভোট দিতে পারেননি। কারণ বুথের যেখানে ইভিএম মেশিন বসানো হয়েছে সেখানে পছন্দের প্রার্থীর প্রতীকে সিলেকশন বাটনে চাপ দেয়া মাত্র দলীয় নেতাকর্মীরা সামনে দাঁড়িয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থীর সিলেকশন ও কনফার্ম ভোটের বাটন টিপতে বাধ্য করেছেন। দলীয় লোকের বাইরে সন্দেহ হলেই তারা ভোটদানের গোপন কক্ষটিতে ঢুকে পড়ছেন। অধিকাংশ কেন্দ্র থেকে বিরোধী প্রার্থীর এজেন্টদের ভয়ভীতি দেখিয়ে বের করে দেয়া হয়। রাজধানীর ধানমন্ডি ও লালবাগ, যাত্রাবাড়ী, মুগদা, মানিকনগর, মতিঝিলসহ বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র সরেজমিন ঘুরে ও ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিশেষ করে বিএনপি মনোনীত মেয়র ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থীদের পক্ষের নেতাকর্মীরা এমন অভিযোগ করেন। তারা ইভিএম পদ্ধতিকে ভালো বলে মন্তব্য করলেও ভোটকেন্দ্রে নিজের ভোটটি পছন্দের প্রার্থীকে দেয়ার পরিবেশ ছিল না বলে জানান। আনেকেই অভিযোগ করে করে বলেন, ‘বুথের ভিতর ভ‚ত’ ছিল তাই আমরা আমাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারিনি।
এদিকে কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতিও খুব কম ছিল। হাতেগোনা দু-একটি কেন্দ্র ছাড়া কোথাও ভোটারদের লাইন চোখে পড়েনি। দু-একজন ভোটারকে এসে ভোট দিয়ে বের হয়ে যেতে দেখা গেছেে ।

ব্রেকিং নিউজ :
Shares