‘ভারতের ভাঙন শুরু’, দেশজুড়ে সঙ্ঘাতের আশঙ্কা


rafiq প্রকাশের সময় : অগাস্ট ৬, ২০১৯, ০৫:২৬ / ২৬৩
‘ভারতের ভাঙন শুরু’, দেশজুড়ে সঙ্ঘাতের আশঙ্কা

বিডি সংবাদ একাত্তর  ডেস্ক  কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা তুলে দিল ভারতের কেন্দ্র সরকার। একইসঙ্গে কাশ্মীকে ভেঙে আলাদা করে দেয়া হল লাদাখকে। দুটি আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হচ্ছে জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ। দু’জায়গাতেই দু’জন লেফটেন্যান্ট গভর্নর নিয়োগ করা হবে। যত বড় পদক্ষেপ, ঠিক ততটাই চড়া স্বরে শুরু হয়েছে বিরোধিতা। এখন থেকেই শুরু হয়ে গেল ভারতের ভাঙন, রাজ্যসভা থেকে বেরিয়ে এমনই চাঞ্চল্যকর মন্তব্য করলেন প্রবীণ কংগ্রেস নেতা তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পি চিদাম্বরম। এদিকে এই সিদ্ধান্তের জেরে ভারতজুড়ে সঙ্ঘাতের সৃষ্টি হতে পারে এ আশঙ্কা থেকেই সমস্ত রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মুখ্যসচিব এবং পুলিশ প্রধানকে নিরাপত্তা বিষয়ক নির্দেশিকা পাঠানো হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে। ওই নির্দেশিকায় সমস্ত রাজ্যের নিরাপত্তা বাহিনীকে চ‚ড়ান্ত সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

কাশ্মীরের দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীসহ একাধিক শীর্ষনেতা গৃহবন্দি। গ্রেফতারও হয়েছেন কেউ কেউ। উপত্যকার বেশ কিছু এলাকায় ইতিমধ্যেই জারি হয়েছে ১৪৪ ধারা। এর জেরে, উপত্যকায় কী হতে চলেছে তা নিয়ে কয়েকদিন ধরেই গুঞ্জন চলছিল। সেই জল্পনার অবসান ঘটল গতকাল সোমবার। এদিন সংসদ শুরু হতেই রাজ্যসভায় সংবিধানের ৩৭০ ধারা তুলে দেয়ার কথা ঘোষণা করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। সঙ্গে সঙ্গেই বিরোধীরা উচ্চস্বরে প্রতিবাদ জানান। কয়েক মিনিটের জন্য মুলতবি হয়ে যায় অধিবেশন। পরে ফের অধিবেশন শুরু হলে বিরোধীদের হৈ-হট্টগোলের মধ্যেই প্রেসিডেন্টের নির্দেশনামা পড়ে শোনান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তবে জম্মু-কাশ্মীরের বিধানসভা বহাল থাকবে।

উপত্যকায় যে কিছু একটা ঘটতে চলেছে, সে ইঙ্গিত অবশ্য মিলছিল ক’দিন ধরেই। অমরনাথ যাত্রা বন্ধ করে দিয়ে হঠাৎই কাশ্মীরে বাড়ানো হয়েছিল আধাসেনার বহর। সম্ভাব্য জঙ্গি হানার খবর পেয়েই কি এই ব্যবস্থা, নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে সরকারের, জল্পনা তৈরি হচ্ছিল তা নিয়েই। পর্যটকদের ফেরানোও হচ্ছিল। রোববার সন্ধ্যায় একটি সূত্রে শোনা যায়, জম্মু-কাশ্মীর পুলিশকে অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যদিও সে কথা অবশ্য স্বীকার করেনি সরকার। তবে সূত্রের খবর, সোপিয়ানের মতো স্পর্শকাতর এলাকাগুলোতে থানা পাহারা দিচ্ছে বিএসএফ। বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়। ফিরিয়ে আনা হয়েছে যুব ক্রিকেটারদেরও।
জম্মু-কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের কথা গতকাল অমিত শাহ রাজ্যসভায় ঘোষণা করা মাত্রই তুমুল হট্টগোল শুরু করে দেন বিরোধী দলগুলোর সাংসদরা। কংগ্রেসের গুলাম নবি আজাদ, তৃণমূলের ডেরেক ও’ব্রায়েন, ডিএমকে-র তিরুচি শিবা, এমডিএমকে-র ভাইকোদের নেতৃত্বে তুমুল বিক্ষোভ শুরু হয়। বিরোধী সাংসদরা ওয়েলে নেমে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। জম্মু-কাশ্মীরের দল পিডিপির দুই সাংসদ সংবিধানের প্রতিলিপি সংসদের মধ্যেই ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করেন।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আগেই রুলিং দিয়েছিলেন রাজ্যসভার চেয়ারম্যান তথা ভাইস প্রেসিডেন্ট ভেঙ্কাইয়া নায়ডু। কিন্তু তাতেও হট্টগোল আটকানো যায়নি। পিডিপি সাংসদদের প্রচন্ড প্রতিবাদের মুখে ভেঙ্কাইয়া মার্শাল ডেকে বার করে দেয়ার নির্দেশ দেন তাদের। হট্টগোলের মধ্যেই অমিত শাহ কাশ্মীর সংক্রান্ত ঘোষণাপত্র এবং বিল পড়ে শোনাতে থাকেন।
চেয়ারম্যানের বিশেষাধিকার প্রয়োগের সুবাদে অমিত শাহ তার কাজ সেরে ফেলেন ঠিকই, কিন্তু তাতে রাজ্যসভার উত্তাপ কমানো যায়নি। কেন্দ্রীয় সরকারকে তথা বিজেপি-কে তীব্র আক্রমণ শুরু করে বিভিন্ন বিরোধী দল। সংসদের ভিতরে শুধু নয়, বাইরেও শুরু হয় ক্ষোভ উগরে দেয়া।

নরেন্দ্র মোদির সরকারকে এবং তার নীতিকে এদিন সবচেয়ে কড়া ভাষায় আক্রমণ করেছেন পি চিদাম্বরম। গুলাম নবি আজাদ, ডেরেক ও’ব্রায়েনদের পাশে নিয়ে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন দেশের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘সাংবিধানিক ইতিহাসে আজ কালো দিন। সরকার যা করেছে, তা অভ‚তপূর্ব।’ চিদাম্বরম গোটা দেশকে সতর্ক করে দেয়া ঢঙে বলেন, ‘এটা যদি জম্মু-কাশ্মীরের সঙ্গে করা যায়, তাহলে দেশের অন্য রাজ্যগুলোর প্রত্যেকটার সঙ্গেই করা যেতে পারে।’ প্রবীণ কংগ্রেস নেতার ব্যাখ্যা, ‘প্রথমে রাজ্যের নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দেয়া হবে, কেন্দ্রের শাসন জারি করা হবে, বিধানসভা ভেঙে দেয়া হবে, বিধানসভার ক্ষমতা সংসদের হাতে যাবে, সরকার সংসদে একটা প্রস্তাব আনবে, সেটাতে সংসদ অনুমোদন দেবে এবং রাজ্যটা আর থাকবে না।’ চিদাম্বরম আশঙ্কা প্রকাশের ভঙ্গিতে বলেন, প্রত্যেকটা রাজ্যকে এভাবে ভেঙে দেয়া যাবে, দুটো অথবা তিনটা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা যাবে। এর পরেই আসে চিদাম্বরমের সবচেয়ে কঠোর মন্তব্যটি। তিনি বলেন, ‘এই সরকার যদি এই পথেই এগোতে থাকে, তা হলে এখন থেকেই ভারতের ভাঙন শুরু হয়ে গেল।’

জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্যসভায় বর্তমানে কংগ্রেসের দলনেতা গুলাম নবি আজাদ বলেন, সংবিধানকে হত্যা করা হল। ভারতের মানচিত্র থেকে একটা রাজ্য আজ মুছে গেল- এমন মন্তব্যও করেন তিনি।
যে প্রক্রিয়ায় এদিন কাশ্মীর সংক্রান্ত বিল সংসদে পেশ করা হয়েছে, তার তীব্র বিরোধিতায় সরব হন রাজ্যসভায় তৃণমূলের দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েনও। ক’টার সময়ে অমিত শাহ বিলটি পেশ করলেন, কখন সেই বিলের প্রতিলিপি সাংসদরা পেলেন, তার উপরে আলোচনার জন্য বা সংশোধনী আনার জন্য কতটুকু সময় দেয়া হল, সে সব নিয়ে প্রশ্ন তুলে সরকারকে তীব্র আক্রমণ করেন ডেরেক। আর বিজেপির অস্বস্তি বাড়িয়ে শরিক দল জেডিইউ বিরোধিতা শুরু করে সরকারের এই সিদ্ধান্তের এবং রাজ্যসভা থেকে জেডিইউ ওয়াকআউট করে।

জম্মু-কাশ্মীরের এক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী যখন রাজ্যসভায় তীব্র আক্রমণে বিঁধছেন সরকারকে, তখন বাকি দুই মুখ্যমন্ত্রী উপত্যকায় গৃহবন্দি। রাজ্যকে যে দু’ভাগে ভেঙে দেয়া হয়েছে এবং দু’টি ভাগকেই যে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়েছে, সে খবর বাড়িতে বসেই পেতে হয়েছে মেহবুবা মুফতি এবং ওমর আবদুল্লাহকে। দু’জনেই সোশ্যাল মিডিয়ার আশ্রয় নিয়ে তীব্র আক্রমণ করেছেন সরকারকে।

‘আজ ভারতীয় গণতন্ত্রের কালোতম দিন। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্ব প্রত্যাখ্যানের এবং ভারতের সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত উল্টো ফল দিল। ৩৭০ ধারা বাতিলের যে সিদ্ধান্ত একতরফাভাবে ভারত সরকার নিয়েছে, তা বেআইনি ও অসাংবিধানিক এবং এই সিদ্ধান্ত ভারতকে জম্মু-কাশ্মীরে একটি দখলদার শক্তিতে পরিণত করবে।’ এই ভাষাতেই এদিন টুইট করেছেন মেহবুবা।

ওমর আবদুল্লাহ টুইটারে যা লিখেছেন, তার বক্তব্যও অনেকটা একই রকম। তার আক্রমণ, ‘১৯৪৭ সালে যখন জম্মু-কাশ্মীর ভারতের সঙ্গে জুড়েছিল, তখন রাজ্যের মানুষ ভারতের উপরে যে বিশ্বাস রেখেছেন, সে বিশ্বাস আজ সম্পূর্ণভাবে ভেঙে দেয়া হল।’ ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্তের সুদূরপ্রসারী এবং বিপজ্জনক ফলাফল হবে বলেও ওমর আবদুল্লাহ এদিন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

ভ‚স্বর্গ কাশ্মীরের শেষ অধিপতি মহারাজা হরি সিংয়ের ছেলে ও লোকসভার কংগ্রেসী সাংসদ ডঃ করণ সিংও এই বিলের বিরোধিতা করেছেন। কাশ্মীরের এই যুবরাজ সাফ জানিয়ে দিলেন, বিজেপি কাশ্মীর নিয়ে যে পন্থাই গ্রহণ করুক তাতে বৈপ্লবিক কিছু ঘটবে না। কারণ কাশ্মীর সমস্যার সমাধান অত সহজ বিষয় নয়। তার তির্যক মন্তব্য, ৩৭০ ধারা বিলোপ করে যদি মোদি মনে করেন, বিরাট কিছু ঘটিয়ে ফেলেছেন বা কাশ্মীর আর আগের মতো থাকবে না তাহলে ভুল ভাবছেন। এ প্রসঙ্গে নিজের অভিমত ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘কাশ্মীর সমস্যা বড় জটিল একটি বিষয়। কারোর হাতেই সেই ম্যাজিক বুলেট নেই, যাতে রাতারাতি কাশ্মীর সমস্যা মিটে যাবে।’

এদিকে, কাশ্মীর নিয়ে ভারতজুড়ে সঙ্ঘাত শুরু হতে পারে বলে মনে করছে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে গতকালই তারা একটি নির্দেশিকা প্রকাশ করেছে। ওই নির্দেশিকাতে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, এই পরিস্থিতিতে গোষ্ঠী সংঘর্ষ হতে পারে। চেষ্টা হতে পারে অশান্তি পাকানোর। সেই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের নাশকতার আশঙ্কাও করা হয়েছে। সেই আশঙ্কার কথা মাথায় রেখেই রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির নিরাপত্তা বাহিনীকে দ্রুত উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা কাশ্মীরের বাসিন্দা এবং ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সুনিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। ওই নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে কাশ্মীরের বাসিন্দাদের মধ্যে নিরাপত্তার অভাব বোধ না হয়, তাদের ভরসা জোগাতে হবে।

ওই নির্দেশিকায় আরো আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যে, শান্তি নষ্ট করার জন্য এবং অশান্তি পাকানোর জন্য সোশ্যাল মিডিয়াতে মিথ্যা প্রচার এবং অপপ্রচার হতে পারে। তাই সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর প্রয়োজনীয় নজরদারি বাড়াতে হবে। যাতে ওই ধরনের উস্কানিমূলক বার্তা এবং খবর রোখা যায়। সূত্র : এনডিটিভি, ডন, টিওআই।ও দৈনিকইনকিলাব।

ব্রেকিং নিউজ :
Shares