পুরো নিউজিল্যান্ড জুড়েই আল্লাহ আকবর ধ্বনিতে মুখরিত,নামাজ এর দুইমিনিট পুর্বে প্রধান মন্ত্রী জাসিন্ডা।


rafiq প্রকাশের সময় : মার্চ ২৩, ২০১৯, ০৪:২৮ / ২৪৭
পুরো নিউজিল্যান্ড জুড়েই আল্লাহ আকবর ধ্বনিতে মুখরিত,নামাজ এর দুইমিনিট পুর্বে প্রধান মন্ত্রী জাসিন্ডা।

ডেস্ক বিডি সংবাদ একাত্তর বিশ্বের মুসলিম অধ্যুষিত প্রতিটি এলাকাতেই প্রতিদিন মসজিদ থেকে ধ্বনিত হয় মহান আল্লাহর মহত্ব-এককত্ব। সউদী আরব ছাড়া আর কোন দেশের টিভিতেই নামাজ সরাসরি সম্প্রচার করা হয় না। কিন্তু ইতিহাসে এই প্রথম বারের মতো গতকাল এক বিরল ঘটনার জন্ম দিয়ে বিশ্বের শীর্ষ টিভি মিডিয়াগুলো তো বটেই খোদ নিউজিল্যান্ডের জাতীয় গণমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে আজান ও জুমা নামাজ। গত ১৫ মার্চ শুক্রবার জুমা নামাজের প্রাক্কালে শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী ব্রেন্টন ট্যারান্টের ব্রাশফায়ারে যে ৫০ মুসলিম শাহাদাতবরণ করেন তাদের প্রতি শোক ও তাদের স্বজনদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশে খোদ নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্নের নেতৃত্বে দেশটির হাজার হাজার মানুষ এসে চতুর্পার্শ্বে প্রাচীরের ন্যায় দাঁড়িয়ে থেকে পাহারা দিয়েছেন। খ্রিস্টসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষের নিশ্চিদ্র পাহারায় কোনো ধরনের আতঙ্ক ছাড়াই নামাজ আদায় করেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা মুসলিমরা। এখানে বারবার সুউচ্চ কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার’। আজান এর মাত্র দুইমিনিট আগে হ্যাগলি পার্কের নামাজস্থলে এসে হাজির হন নিউজিল্যান্ডের মানবদরদী মাথায় স্কার্ফ পরা প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন। তিনি গত বুধবার দেশটির সরকারি গণমাধ্যমকে জুমা নামাজ সরাসরি সম্প্রচারের নির্দেশ দেন। নিউজিল্যান্ড টিভির সৌজন্যে বিবিসি, সিএনএন, স্কাইনিউজ, আল-জাজিরাসহ বিশ্বের প্রধান প্রধান গণমাধ্যম আজান ও নামাজ সরাসরি সম্প্রচার করে। তবে যারা বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচার দেখার জন্য চ্যানেলের পর চ্যানেল পাল্টেছেন তারা হয়েছেন হতাশ। জাতীয়ভাবে শোক প্রকাশের অংশ হিসেবে এসময় দু’মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। মাত্র কয়েকটি শব্দে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন। এ সময় মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর হাদীস উদ্ধৃত করে তিনি সবাইকে এক হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আপনাদের সঙ্গে পুরো নিউজিল্যান্ডই ব্যথিত। আমরা সবাই এক।’ তিনি বলেন, ‘মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, বিশ্ববাসী পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহানুভূতি দিয়ে একটি শরীরের মতো থাকবেন। যখন শরীরের কোনো অঙ্গে ব্যথা হয় তখন পুরো শরীরে ব্যথা হয়। জুমা নামাজ শেষে ১৫ মার্চ শাহাদাতবরণকারী ২৬ মুসলিমের জানাযা ও দাফন সম্পন্ন হয় লিনউড মোমেরিয়াল সেমিট্রিতে। এদের মধ্যে ছিল সর্বকনিষ্ঠ শহীদ ৩ বছরের ছোট্ট মুসাদ ইব্রাহিমের লাশও। নামাজের আগে স্থানীয় সময় ১টা ৩২ মিনিটে ২ মিনিটের নীরবতা পালন শুরু হয়। লাইভ প্রচার থাকায় যে যেখানে ছিলেন দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রীয় কর্মসূচিতে শরিক হন। এদিন নামাজ পরিচালনাকারী ইমাম জামাল ফাওদা তাঁর খুতবায় বলেন, ওই বন্দুকধারী এখানে হামলা চালিয়ে বিশ্বের লাখ লাখ মানুষের হৃদয় ভেঙে দিয়েছে। আজ সেই একই জায়গা থেকে আমি শুধু ভালোবাসাই দেখতে পাচ্ছি। তিনি বলেন, আমাদের হৃদয় ভেঙে গেছে, কিন্তু আমরা ভেঙে পড়িনি। আমরা জীবিত ও আমরা এক। আমরা কাউকেই আমাদের মাঝে বিভক্তি তৈরি করতে দেবো না। জুমার নামাজের খুতবায় তিনি আরো বলেছেন, নিউজিল্যান্ডের জনগণের মাঝে বিভাজন তৈরির চেষ্টা করে সফল হয়নি হামলাকারী। খুতবা দিতে গিয়ে ইমাম জামাল এক সপ্তাহ আগের সে ভয়াবহ ঘটনাকে স্মরণ করেন। বলেন, ‘গত শুক্রবার আমি এ মসজিদে ছিলাম এবং ওই সন্ত্রাসীর চোখে ঘৃণা আর ক্রোধ দেখেছি। আর আজ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে যখন তাকাচ্ছি, তখন আমি লাখো নিউজিল্যান্ডবাসী ও বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষের চোখে ভালোবাসা আর সহানুভূতি দেখতে পাচ্ছি।’

ইমাম জামাল আরও বলেন, ‘যে মন্দ মতাদর্শ বিশ্বকে বিভাজিত করে দিয়েছে, সে মতাদর্শ ব্যবহার করে আমাদের দেশে বিভাজন তৈরি করতে চেয়েছিল এ সন্ত্রাসী। তবে আমরা দেখিয়ে দিয়েছি, নিউজিল্যান্ড অবিচ্ছেদ্য।’
এ হামলার কারণ হিসেবে বিদ্বেষমূলক বক্তব্যকে দায়ী করেছেন ইমাম জামাল। এ ধরনের বিদ্বেষমূলক বক্তব্য বন্ধ করতে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। ইমাম জামাল বলেন, ‘কিছু সংখ্যক রাজনৈতিক নেতা, সংবাদমাধ্যম ও অন্যদের ইসলামবিরোধী এবং মুসলিমবিরোধী বক্তব্যের ফলাফল এটি। গত সপ্তাহের ঘটনায় গোটা বিশ্বের কাছে প্রমাণ হয়েছে, সন্ত্রাসবাদের কোনও রঙ নেই, বর্ণ নেই, ধর্ম নেই।’
হামলাকারীর কবল থেকে বাঁচানোর জন্য যারা তাদের সেদিন নিজেদের ঘরের দরজা খুলে দিয়েছিলেন, গাড়ি নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন সেসব প্রতিবেশীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন জামাল। হতাহতদের পরিবারকে নিবিড়ভাবে আগলে রাখায় এবং মুসলিমদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মাথায় কাপড় দেওয়ায় জাসিন্ডা আরডার্নকেও ধন্যবাদ জানান তিনি। বলেন, ‘তার নেতৃত্ব এ বিশ্বের জন্য শিক্ষণীয়।’
আল নূর মসজিদের ঠিক বিপরীতে হ্যাগলি পার্কে, যেখানে নামাজের আয়োজন করা হয় তার চারপাশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ দাঁড়িয়ে থেকে মুসলিমদের সাথে সহমর্মিতা প্রকাশ করেন। তার নামাজের সৌন্দর্য কাছ থেকে দেখে মুগ্ধ হন। এসময় অনেকের চোখে পানি দেখা যায়।
গতকাল আল নূর মসজিদ ছাড়াও দেশের অন্যান্য মসজিদও সব ধর্মাবলম্বী মানুষের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। মসজিদগুলোর সামনে ভালোবাসা ও সুরক্ষার প্রতীক হিসেবে মানববন্ধন করেন নিউজিল্যান্ডবাসী।
হামলার পর থেকেই নিউ জিল্যান্ডবাসীও এই মর্মান্তিক ঘটনায় নিহতদের স্মরণে শ্রদ্ধা জানিয়ে যাচ্ছেন। ফুল দেওয়ার স্থানগুলো ভরে গেছে। ফুলের সঙ্গে রয়েছে সমবেদনা জানিয়ে লেখা চিরকুটও। এছাড়া হতাহতদের প্রতি সংহতি ও দেশটিতে বসবাসরত মুসলিমদের প্রতি সম্মান জানিয়ে কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশন শুরু করে নিউজিল্যান্ড। মুসলিম রীতিতে সালাম দিয়ে ভাষণ শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী। মসজিদে হামলায় হতাহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাতে গিয়ে পার্লামেন্টের স্পিকারকে সম্বোধন করে জাসিন্ডা বলেন, মিস্টার স্পিকার, আসসালামু আলাইকুম। পরে ইংরেজিতে বলেন, পিস বি আপন উইথ ইউ (আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক)।
১৫ মার্চ ২৮ বছর বয়সী অস্ট্রেলীয় নাগরিক ব্রেন্টন ট্যারান্ট নামের সন্দেহভাজন হামলাকারীর লক্ষ্যবস্তু হয় নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদ। শহরের হাগলি পার্কমুখী সড়ক ডিনস এভিনিউয়ের আল নূর মসজিদসহ লিনউডের আরেকটি মসজিদে তার তান্ডবের শিকার হয় অর্ধশত মানুষ। শুধু আল নূর মসজিদে হামলায় প্রাণহানি হয় ৪৩ জনের। ঘটনার দিন আল সেখানে ছিলেন ইমাম জামাল ফাওদা। তবে প্রাণে বেঁচে যান তিনি। ভয়াবহ সে হামলার এক সপ্তাহ পর আবারও খুলেছে আল নূর মসজিদ। সূত্র : এএফপি, বিবিসি, রয়টার্স, নিউজিল্যান্ড হেরাল্ড।

ব্রেকিং নিউজ :
Shares