জি,কে,শামিম ছিল মির্জা আব্বাসের ক্যাডার,যুবলীগেরকেউ নয়,যুবলীগ,চেয়ারম্যান,ওমর ফারুক।


rafiq প্রকাশের সময় : সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৯, ০৯:২৯ / ২১২
জি,কে,শামিম ছিল মির্জা আব্বাসের ক্যাডার,যুবলীগেরকেউ নয়,যুবলীগ,চেয়ারম্যান,ওমর ফারুক।

বিশেষ সংবাদ দাতা  রাজধানীর নিকেতনে অভিযান চালিয়ে যুবলীগ নেতা এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীমকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। এ সময় কার্যালয় থেকে নগদ প্রায় দুই কোটি টাকা, পৌনে দু’শো কোটি টাকার এফডিআর, আগ্নেয়াস্ত্র, বিদেশি মদ ও বিপুল পরিমাণ ডলার জব্দ করা হয়েছে। অভিযানকালে তার সাত দেহরক্ষীকেও গ্রেফতার করা হয়।

গতকাল দিনভর নিকেতনের বাসা (১১৩ নম্বর) ও জি কে বিল্ডার্স কার্যালয়ে (১৪৪ নম্বর) এ অভিযান চলে। সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে র‌্যাব-১ এর কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয় শামীমকে। র‌্যাবের দাবি, শামীমের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির অভিযোগ রয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই এ অভিযান চালানো হয়েছে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম ও র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, সকাল ৮টার দিকে শামীমকে নিকেতনের ১১৩ নম্বর বাসা থেকে আটক করে তার অফিসে অভিযান চালানো হয়। অভিযানে তার অফিস থেকে বিভিন্ন ব্যাংকে এফডিআর করে রাখা ১৬৫ কোটি ২৭ লাখ টাকার নথি, ১ কোটি ৮১ লাখ ২৮ হাজার নগদ টাকা, ৯ হাজার মার্কিন ডলার ও ৭৫২ সিঙ্গাপুরি ডলার, কয়েক বোতল বিদেশি মদ এবং ৮টি আগ্নেয়াস্ত্র জব্দ করা হয়।

জানা যায়, গ্রেফতার জি কে শামীম নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার সন্মানদী ইউনিয়নের দক্ষিণপাড়া গ্রামের মৃত মো. আফসার উদ্দিন মাস্টারের ছেলে শামীম। তার হরিহরদি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিন ছেলের মধ্যে শামীম মেজো।

শামীমের মালিকানাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিকেবি অ্যান্ড কোম্পানির কর্মচারী দিদারুল আলম বলেন, ভোরে নিকেতনের ৫ নম্বর সড়কের ১১৩ নম্বর ভবনে সিটি কর্পোরেশনের লোক বলে সাদা পোশাকে র‌্যাবের কয়েকজন সদস্য প্রবেশ করেন। সেখানে প্রায় তিন ঘণ্টা অবস্থানের পর শামীমকে সঙ্গে নিয়ে তার প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় ১৪৪ নম্বর ভবনে গিয়ে অভিযান শুরু করে র‌্যাব। তিনি আরো বলেন, শামীমের বাসায় সাতজন গার্ড ছিলেন। তাদের সঙ্গে থাকা অস্ত্রের লাইসেন্স দেখতে চাইলে দেখানো হয়। কিন্তু এরপরেও অস্ত্রসহ তাদেরকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

অভিযান শেষে নিকেতনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে করে র‌্যাব। ওই সম্মেলনে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, জি কে শামীম একজন প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদার। তার অফিসে টাকা থাকা স্বাভাবিক। তবে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজিতে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠে এসেছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার কাছে থাকা বিপুল পরিমাণ অর্থের উৎস নিয়ে তদন্ত করছে র‌্যাব।

অভিযানে অংশ নেয়া র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, তার মায়ের নামে ১৪০ কোটি টাকার এফডিআর পাওয়া গেছে। যদিও তার মা বড় কোনো ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। বাকি টাকা তার নিজের নামে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ী হিসেবে তার কাছে নগদ টাকা থাকতে পারে। তবে তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ ছিল। তার দেহরক্ষীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র প্রদর্শন করে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজিরও অভিযোগ রয়েছে। একইসঙ্গে তার কক্ষে মাদক পাওয়া গেছে, যেটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তার বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগগুলো তিনি কোর্টে মিথ্যা প্রমাণ করতে পারলে ছাড়া পাবেন।

অভিযানকালে ভবনটি সরেজমিনে দেখা গেছে, বেলা ২টা ৪৫ মিনিটে ওই বাসায় ঢুকে প্রথমেই দেখা যায় বিশাল গ্যারেজ। গ্যারেজের পাশে কাঁচ দিয়ে ঘেরা একটি অফিসকক্ষ, এখানে কর্মচারী ও কর্মকর্তারা বসেন। ওই ঘরের পাশে দুটি দামি মোটরসাইকেল রাখা রয়েছে। কক্ষের পাশে দুই পাল্লার একটি কাঠের দরজা। দরজার দামি কাঠের চৌকাঠ চোখে পড়ার মতো। দরজা দিয়ে ঢুকতেই ভেতরে তিন তলায় যাওয়ার সিঁড়ি। মার্বেল টাইলসের সিঁড়িটিতে রয়েছে নকশা করা কাঠের রেলিং। চারতলা পর্যন্ত উঠে গেছে সিঁড়িটি। পুরো বাসাটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। তৃতীয় তলায় শামীমের বসার কক্ষ। প্রায় ৩০ ফুট লম্বা ও ২০ চওড়া কক্ষটি। পুরো কক্ষটিতে দামি বাতি। বিশাল ঝাড়বাতি। পুরো ঘরটি কাঠ দিয়ে সাজানো। বিশাল আকারের দুটি টিভি রয়েছে ঘরে। তিন সেট সোফা ও একটি বড় টেবিল রয়েছে। ওই টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখা হয়েছে টাকার বান্ডিল, মদের বেশ কয়েকটি বোতল ও অস্ত্র। এগুলো ওই কক্ষ থেকে পাওয়া গেছে। ওই কক্ষের পাশেই আছে শামীমের ব্যক্তিগত কক্ষ। এই অফিসের চতুর্থ তলায় ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ওয়ার্কিং সেকশন এবং তৃতীয় তলায় অ্যাকাউন্টস সেকশন।

অভিযানকালে উপস্থিত সাংবাদিকদের দেখে হতভম্ব হয়ে যান শামীম। তিনি সাংবাদিকদের ছবি না তুলতে অনুরোধ করেন। শামীম বলেন, আল্লাহর ওয়াস্তে ছবি তুইলেন না, আমাকে বেইজ্জতি কইরেন না। আমার একটা সম্মান আছে। এখানে যা হচ্ছে, আপনারা দেখছেন। কিন্তু আমাকেও আত্মপক্ষ সমর্থন করতে দিতে হবে।
আওয়ামী লীগ, পুলিশসহ আরও কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর সবুজবাগ, বাসাবো, মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় জি কে শামীম প্রভাবশালী ঠিকাদার হিসেবে পরিচিত। গণপূর্ত ভবনের বেশির ভাগ ঠিকাদারি কাজই তিনি নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলেও গণপূর্তে তিনি ছিলেন ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি।

শামীম একসময় বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের ক্যাডার ছিলেন। বিএনপির আমলে মতিঝিল, পল্টন, শান্তিনগর এলাকায় সন্ত্রাসী আর চাঁদাবাজি করা ছিল তার পেশা। ওই সময় মির্জা আব্বাসের ডানহাত হিসাবে গণপূর্ত ভবনের সকল টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরেও তিনি বহাল তবিয়তে ছিলেন। বাংলাদেশের সকল ঠিকাদারকে গণপূর্তে কাজ করতে হলে তাকে বলে কাজ করতে হয়। কেন্দ্রীয় যুবলীগের নেতা হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দিয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। সারা বাংলাদেশের কনস্ট্রাকশনের সব বড় কাজ তার নির্বাচিত ঠিকাদরি প্রতিষ্ঠান ছাড়া কেউ করতে পারে না।
সন্মানদী ইউনিয়নের বাসিন্দারা বলেন, প্রাইমারি স্কুল ও হাই স্কুল পাস করার পর তাদের গ্রামে দেখা যায়নি। ঢাকার বাসাবো আর সবুজবাগ এলাকায় বড় হয়েছেন। গত জাতীয় নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচনের জন্য প্রচারণাও চালিয়েছিলেন শামীম।

বাসাবো ও এজিবি কলোনির কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, গ্রাম থেকে ঢাকায় আসার পর এজিবি কলোনি, হাসপাতাল জোন এবং মধ্য বাসাবোতেই পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন শামীম। ৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের মাধ্যমেই তার রাজনীতি শুরু। পরবর্তীতে মির্জা আব্বাসের ভাই মির্জা কালু ও মির্জা খোকনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় এবং তাদের সহযোগিতায় ধীরে ধীরে গণপূর্ত ভবনের ঠিকাদারি ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেন। ঢাকা মহানগর যুবদলের সহসম্পাদকের পদও বাগিয়ে নেন। একসময় মির্জা আব্বাস আর খালেদা জিয়া, তারেক রহমানের ছবিসহ সবুজবাগ-বাসাবো এলাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় তার ব্যানার-পোস্টার শোভা পেত। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এখন যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের ছবিসহ পোস্টার-ব্যানার পাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ ও স্থানীয়রা বলেন, গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কিংবা যুবলীগের পার্টি অফিস, বিয়ে বাড়ি কিংবা বন্ধুর বাড়ি, যেখানেই যান না কেন তিনি সবসময় অস্ত্রধারী প্রটোকল বাহিনী নিয়ে চলাফেরা করেন। ভারী অস্ত্র নিয়ে ৬ জন নিরাপত্তারক্ষী আগে-পিছে পাহারা দিয়ে তাকে নিয়ে যায়।

তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে সম্পত্তি অর্জনের অভিযোগও রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলেন, বাসাবো এলাকায় পাঁচটি বাড়ি এবং একাধিক প্লট রয়েছে। বাসাবোর কদমতলায় ১৭ নম্বরের পাঁচতলা বাড়িটিতে কয়েকবছর আগে থাকলেও বর্তমানে বনানীর ওল্ড ডিওএইচএসে নিজের ফ্ল্যাটে থাকতেন। তবে নিজের কার্যালয় হিসেবে নিকেতনের ৫ নম্বর সড়কের ১১৩ নম্বর ভবনটি ব্যবহার করতেন। ওই ভবনের চারতলায় তার প্রতিষ্ঠান জি কে বি কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেডের অফিস। বাসাবোতে আরও তিনটি ভবন এবং ডেমরা ও দক্ষিণগাঁও ছাড়াও সোনারগাঁ উপজেলা, বান্দরবান ও গাজীপুরে কয়েকশ’ বিঘা জমি কিনেছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে, শামীম যুবলীগের কেউ নয় বলে দাবি করেছেন সংগঠনটির চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী। তিনি বলেন, লোকমুখে শোনা গেলেও তার সঙ্গে যুবলীগের কোনো সম্পর্ক নেই। সংগঠনটির শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক মিজানুল ইসলাম মিজু বলেন, শামীম যুবলীগের কেউ নন, তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি।

তবে আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাদের সূত্রে জানা যায়, শামীম নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পদে আছেন। মূল কমিটি অনুমোদনের পর বেশ কয়েকজনকে সহ-সম্পাদক থেকে শুরু অনেক পদই দেয়া হয়েছে। আর আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সমবায়বিষয়ক সম্পাদক এস এম মেজবাহ হোসেন বুরুজ ২০১৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর মারা যাওয়ার পর শূন্য পদটি দেয়া হয়েছে জি কে শামীমকে। শামীম ওই পদ ব্যবহার করে সাংগঠনিক কর্মকান্ড চালিয়ে আসছেন বলে আওয়ামী লীগের কয়েকটি সূত্র জানায়।

ব্রেকিং নিউজ :
Shares