চট্টগ্রামে বিস্ফোরণে দেয়াল ধসে নিহত ৭ আহত ১৫


rafiq প্রকাশের সময় : নভেম্বর ১৮, ২০১৯, ০৪:৩৮ / ২৪৪
চট্টগ্রামে বিস্ফোরণে দেয়াল ধসে নিহত ৭ আহত ১৫

বিডি সংবাদ একাত্তর চট্টগ্রাম প্রতিনিধি   দিশলাইয়ে আগুন ধরাতেই বিকট শব্দে প্রচন্ড বিস্ফোরণ। ধসে পড়ে ভবনের দেয়াল। দেয়াল চাপা আর ইটের আঘাতে প্রাণ হারান নারী, শিশুসহ সাতজন। আহত হন আরও ১৫ জন। তাদের মধ্যে ১০ জনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ভর্তি করা হয়েছে হাসপাতালে। গতকাল রোববার সকালে চট্টগ্রাম নগরীর পাথরঘাটার একটি বাড়িতে ভয়াবহ এই বিস্ফোরণ ঘটে।

বিস্ফোরণে ব্রিক ফিল্ড রোডের বড়–য়া ভবনের (কুঞ্জমণি) নিচতলার দেয়াল ধসে পড়ে। দেয়াল চাপা পড়ে হতাহতদের বেশিরভাগই পথচারী ও রিকশা আরোহী। সকালে স্কুল এবং কর্মস্থলের উদ্দেশে বের হয়ে বেঘোরে লাশ হন সাতজন। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় নিহতের স্বজনদের আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে উঠে। এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া।

বিস্ফোরণের সময় ভবনের নিচতলা থেকে আসবাবপত্র ছিটকে রাস্তায় চলে আসে। দেয়ালের ইটগুলো ‘বোমার’ মতো চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সবকিছু তছনছ করে দেয়। ছিটকে পড়া দেয়ালের আঘাতে ওই ভবন থেকে ১৬ ফুট দূরের আরও একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সময় আশপাশের পুরো এলাকা কেঁপে উঠে। কয়েকটি ভবনের জানালা কাচ ভেঙে যায়।

পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা ভবনের গ্যাস লাইনের রাইজারের লিকেজ থেকে গ্যাস জমে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছে। তবে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, গ্যাস লিকেজের কোনো প্রমাণ মিলেনি। ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিস এবং সিডিএর পক্ষ থেকে চারটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

বিস্ফোরণে কেঁপে উঠে পাথরঘাটা
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ৯টায় হঠাৎ বিকট শব্দে প্রচন্ড বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠে পুরো এলাকা। চারতলা বড়–য়া ভবনের নিচতলার রাস্তার লাগোয়া দেয়ালটি ধসে পড়ে। দেয়ালের ইট ছিটকে পড়ে রাস্তায়। ব্যস্ততম ওই সড়কে পথচারী এবং রিকশা আরোহীরা চাপা পড়েন। ইটের আঘাতে তাদের অনেকের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। সেখান থেকে ১৭ জনকে উদ্ধার করে চমেক হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা সাতজনকে মৃত ঘোষণা করেন। ভবনের পূর্ব এবং পশ্চিম পাশের সীমানা দেয়ালও ধসে যায়। দেয়ালের ইটের আঘাতে বড়–য়া ভবনের সামনে বাদশা মিয়া ভবনের নিচতলার একটি ডিসপেনসারি, একটি স্টুডিও এবং বাড়ির কলাবসিপল গেইট দুমড়ে মুচড়ে যায়।

ভবনের চতুর্থ তলার বাসিন্দা স্কুল শিক্ষক অঞ্জন কান্তি দাশ জানান, সকালে বিকট বিস্ফোরণের সঙ্গে পুরো বাড়ি কেঁপে ওঠে। বাসার জানালার কাচ ভেঙে যায় এবং অনেক জিনিসপত্র মেঝেতে পড়ে যায়। কী ঘটেছে বোঝার জন্য নিচে নামার সময় দেখি দোতলার দরজা জানালাও ভেঙে গেছে বিস্ফোরণের ধাক্কায়। ৩৪ নম্বর পাথরঘাটা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইসমাইল বালি বলেন, ব্রিক ফিল্ড রোড সকাল থেকেই ব্যস্ত থাকে। বড়ুয়া বিল্ডিংয়ে যখন বিস্ফোরণ হল তখন রাস্তায় অনেক মানুষ আর রিকশা ছিল। তিনটি রিকশা দুমড়ে মুচড়ে গেছে।

স্বজনদের আহাজারি
নিহতদের মধ্যে ছয়জনের পরিচয় মিলেছে। তারা হলেন, পটিয়ার মেহের আটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা অ্যানি বড়–য়া (৪০)। কক্সবাজারের উখিয়ার নুরুল ইসলাম (৩০), রাঙ্গুনিয়ার কাজল নাথের কন্যা নগরীর কৃষ্ণকুমারী স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী অর্পিতা নাথ (১৬), কর্ণফুলী ব্রিজ এলাকার বাস্তুহারা কলোনীর নুরুল ইসলাম (৩২), পাথরঘাটা এলাকার বাসিন্দা জুলেখা খানম ফারজানা (৩০) ও তার শিশু পুত্র সেণ্ট প্লাসিড স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র আতিকুর রহমান শুভ। অ্যানি বড়ূয়া ওই ভবনের কাছেই আরেকটি ভবনে পরিবার নিয়ে থাকতেন। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার দায়িত্ব পালন করতে বের হয়েছিলেন তিনি। ওই বাসার সামনে যেতেই দেয়াল চাপা পড়েন তিনি। সেখানেই তার মৃত্যু হয়।

তার স্বামী শিকলবাহা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার পলাশ বড়ুয়াকে হাসপাতালে আহাজারি করতে দেখা যায়। শিশু পুত্র আশিকুর রহমানকে নিয়ে আহাজারি করছেন আইনজীবী আতাউর রহমান। বড় ছেলে আতিকুর রহমান শুভসহ মারা যান স্ত্রী ফারজানা। তিনি জানান, প্রাইভেট পড়াতে ছেলেকে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন ফারজানা। মা ছেলে দুজনই ফিরলেন লাশ হয়ে।

পেশায় রং মিস্ত্রি নুরুল ইসলাম পাশের একটি ভবনে কাজ শুরুর আগে বড়ুয়া ভবনের উল্টো দিকে একটি টং দোকানে নাস্তা খেতে বসেন। দোকান মালিক মঞ্জুর হোসেন বলেন, চা খেয়ে বের হওয়ার সময় ভবনে বিস্ফোরণ ঘটে। আর একটি ইট ছিটকে এসে তার মাথায় পড়ে। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। ইটের আঘাতে টং দোকানটি ধসে পড়লে তাতে চাপা পড়ে আহত হন মঞ্জুর হোসেন। আহতদের বেশিরভাগই পথচারী বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা। আহত দশজনের মধ্যে ক্যাজুয়ালটিতে ৫ জন, কার্ডিওলজি বিভাগে দুইজন এবং অর্থোপেডিকে, নিউরো ও বার্ন ইউনিটে একজন করে ভর্তি আছেন। আহতরা হলেন- মোহাম্মদ ইসমাইল (৩০), মোহাম্মদ আবদুল হামিদ (৪০), মোহাম্মদ ইউসুফ (৪০), মোহাম্মদ আরিফ (১৫), মোহাম্মদ নাছির (৩৫), ডরিন তৃষা গোমেজ (২৩), সন্ধ্যা রাণী নাথ (৪৫), অর্পিতা নাথ (১৬) ও আবু তালেব (৪৫)। এদের মধ্যে অর্পিতা নাথকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে প্রেরণ করা হয়েছে।

গ্যাসের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণ
ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক পূর্ণচন্দ্র মুৎসুদ্দী জানান, ভবনের নিচতলায় সীমানা প্রাচীরের পাশেই ওই বাড়ির গ্যাস রাইজার। বিস্ফোরণটি নিচতলাতেই হয়েছে। মনে হচ্ছে রাইজারে কোনো সমস্যা ছিল, লিকেজ থেকে গ্যাস বের হয়ে জমে গিয়েছিল। কেউ আগুন ধরালে তাতে বিস্ফোরণ ঘটে থাকতে পারে। ওই বাসার বাসিন্দা অগ্নিদগ্ধ সন্ধ্যা নাথ জানান, সকালে পূজার ঘরে মোমবাতি জ্বালাতে দিশলাইয়ের কাঠি ধরাতেই ঘটে বিস্ফোরণ। তিনি দগ্ধ হলেও বাসায় আগুন ধরেনি।

এ সময় বিস্ফোরণে ঘরের আসবাবপত্রের সাথে তিনিও রাস্তায় ছিটকে পড়েন। তবে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসা কেজিডিসিএল’র জিএম আ ন ম সালেক বলেন, গ্যাস লাইনে ক্রুটি থাকার কোনো প্রমাণ তারা পাননি। ওই বাসার গ্যাসের চুলা অক্ষত আছে। লাইনে লিকেজের কোনো আলামতও নেই। বিস্ফোরণে সীমানা দেয়াল গ্যাসের রাইজারে ওপর পড়ায় ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বিস্ফোরণের কারণ কী তা তদন্তের পর জানা যাবে।

মানা হয়নি বিল্ডিং কোড
বড়–য়া ভবনটি বিল্ডিং কোড না মেনে তৈরি করা হয়েছে বলে জানালেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএর প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহিনুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, নিচতলার দুইটি কক্ষ নকশার বাইরে তৈরি করা হয়েছে। সেখানে দেয়ালের ভেতর গ্যাস ও পানির লাইন ছিল। গ্যাসের রাইজারের পাশেই রান্না ঘর। রাস্তা দখল করে সেফটি ট্যাংক তৈরি করা হয়েছে। সেফটি ট্যাংকের গ্যাস থেকেও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে। তদন্ত করে ভবন মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি। দুর্ঘটনার পর বড়–য়া ভবন এবং তার সামনে ক্ষতিগ্রস্ত বাদশা মিয়া ভবনের বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হবে। তিনি বলেন, দুটি ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। বড়ুয়া ভবনের মালিক অমল বড়ুয়া ও টিটু বড়ুয়া থাকেন ভবনের ছাদে টিনসেডের ঘরে। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া ওই বাড়ির চারতলা তারা ভাড়া দিয়েছেন।

দুর্ঘটনাস্থলে মেয়র তদন্ত কমিটি
দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। তিনি ইনকিলাবকে জানান, নিহত সাতজনের পরিবারকে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে এক লাখ টাকা করে দেয়া হবে। এছাড়া লাশ বাড়িতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১০ জনের চিকিৎসা ব্যয়ও আমরা বহন করব। এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে তা নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে চট্টগ্রামের ডিসি মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন, বিস্ফোরণের কারণ খতিয়ে দেখতে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ জে এম শরিফুল হাসানকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করার কথা জানান। তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশন, সিডিএ, ফায়ার সার্ভিস প্রতিনিধি ও স্থানীয় কাউন্সিলর এ কমিটির সদস্য থাকছেন। তাদেরকে পাঁচ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া নগর পুলিশের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান হলেন উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) এস এম মেহেদী হাসান। ফায়ার সার্ভিস ও সিডিএর পক্ষ থেকেও ঘটনা তদন্ত করা হচ্ছে।

ব্রেকিং নিউজ :
Shares