চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে ১৮ বছরে ২৫৩ জনের প্রাণহানি।।


rafiq প্রকাশের সময় : ডিসেম্বর ১১, ২০১৮, ২০:৫৫ / ১৬৯
চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে ১৮ বছরে ২৫৩ জনের প্রাণহানি।।

**জসিম মাহমুদ**
পাহাড়, প্রকৃতির আশীর্বাদ। কিন্তু এ পাহাড়গুলোই যেন দিন দিন ‘অভিশাপ’ হয়ে উঠছে, অন্তত চট্টগ্রামবাসীর জন্য! কারণ, গত দেড় যুগে পাহাড় ধসে এখানে প্রাণ হারিয়েছেন ২৫৩ জন। অর্থাৎ প্রতি বছর ১৪ জন করে মারা গেছেন পাহাড় ধসের কারণে। অবশ্য এ পাহাড় ধসের জন্য মানবসৃষ্ট কারণকেই দায়ী করছেন পরিবেশবিদরা। এ সংক্রান্ত সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন নথি পর্যালোচনায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ‘এখানে ধসের মূল কারণ, পাহাড় কাটা।’ এ বিষয়ে গত ২০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘পাহাড় কাটার ফলে ভূমির ঢাল বৃদ্ধি পায়, গাছপালার আচ্ছাদন বিনষ্ট হয়, মাটির দৃঢ়তা হ্রাস পায় এবং বৃষ্টির পানি মাটির গভীরে প্রবেশ করে। এতে পাহাড় ধস হয়।’ চট্টগ্রাম জেলায় অবৈধ বাসস্থান নির্মাণ, ইটভাটায় মাটি ব্যবহার এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্যই এসব পাহাড় কাটা হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
২০০৭ সালে চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনার পর গঠিত কমিটির তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ আছে, ‘চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়গুলো ভূ-তাত্ত্বিক গঠনে ‘সার্ফেস সয়েল’-এ (পৃষ্ঠের মাটি) বালির আধিক্য থাকায় পাহাড়ের উপরিভাগ ‘কমপেক্ট’ (নিশ্ছিদ্র) নয়। অত্যধিক বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড়ের মাটির বন্ধন ক্ষমতা হ্রাস পেয়ে পাহাড়ের উপরিভাগের বালির স্তরযুক্ত মাটি বাধাহীনভাবে অত্যন্ত গতিতে ধসে পড়ে। এছাড়া পাহাড়ের উপরিভাগ শন ও ঝোপ জাতীয় গাছপালা দ্বারা আচ্ছাদিত, যা মাটিকে ধরে রাখতে পারে না।’ এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) সাবেক ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘বিভিন্ন সময় বসতি স্থাপন করার জন্য পাহাড় কাটা হয়। কিন্তু অবৈধ ভাবে বসতি স্থাপন ছাড়াও বৈধভাবে বসতি স্থাপন করার ক্ষেত্রে ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতিতে নির্মাণের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয় না। দ্বিতীয়ত পাহাড়ের পাদদেশে বসতি স্থাপন করা উচিত নয়। কিন্তু অনেকে অবৈধভাবে পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন করছেন। এসব যতদিন বন্ধ হবে না ততদিন পাহাড়ধসে প্রাণহানিও বন্ধ হবে না।’
এ প্রকৌশলী বলেন, ‘পাহাড়ের উপরের স্তরটা কিছুটা শক্ত থাকলেও ভেতরে কিন্তু বালি-মাটি। এক ফোটা পানি পড়লেও বালির স্ট্যাবলিটি-টা হারিয়ে যায়। তবে বলতে পারেন, আগেও তো বালির পাহাড় ছিল। তখন তো ধস তেমন হতো না। এখন হচ্ছে কেন? এ ক্ষেত্রে বলব, পাহাড়গুলো বসতি স্থাপন করার জন্য কাটা হচ্ছে। তাই এর ভারসাম্যটা নষ্ট হচ্ছে বলেই দুর্ঘটনা ঘটছে।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে পাহাড়গুলোর মালিকদের ডাকা হোক। তাদেরকে বলতে হবে, যার পাহাড় হোক না কেন, কোনো লোক মারা গেলে তার দায় পাহাড়ের মালিককে নিতে হবে। সেটা যদি করতে তাকে বাধ্য করা হয়, তখন সে ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতিতে পাহাড়গুলো রক্ষায় ব্যবস্থা নিবে।’
অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতার বাইরে থাকা দলের স্থানীয় নেতাদের কেউ কেউ প্রভাব খাটিয়ে অবৈধভাবে পাহাড় দখল নিয়ে বসতি নির্মাণ করেছেন। যদিও পাহাড়গুলোর মালিকানা রয়েছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার। এছাড়া পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাথে যোগসাজশ করে অবৈধভাবে সংযোগও স্থাপন করা হচ্ছে। প্রভাবশালী মহলটি নিজেদের নিয়োগকৃত লোকের মাধ্যমে পাহাড়গুলোতে ভাড়াটিয়ার ব্যবস্থা করেন এবং ভাড়াও আদায় করেন। ফলে বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় প্রশাসন চাইলেও এখানে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ করতে পারছে না। এমনকি প্রশাসনের অভিযানেও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সহযোগিতা না করার অভিযোগ আছে।
কেউ কেউ বলছেন, জাতীয় এবং সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী অংক কষেই রাজনীতিবিদরা অসহোযোগিতা করেন উচ্ছেদ অভিযানে। কারণ, নগরীর সরকারি ও বেসরকারি মালিকানাধীন বিভিন্ন পাহাড়ে বাস করে প্রায় ২ লক্ষ পরিবার। জেলা প্রশাসনের অধীনে গঠিত পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস পরিদর্শন কমিটির ২০০৭ সালের জরিপ থেকেই এই হিসেবটি জানা যায়।
অবশ্য, গতকাল ফিরোজশাহ কলোনিতে পাহাড় ধসে প্রাণহানির পর চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) দেলোয়ার হোসেন বলেছেন, ‘ওই এলাকায় অবৈধভাবে যারা পাহাড় কেটে বসতি তৈরি করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
১৮ বছরে ২৫৩ প্রাণহানি:
২০১৭ সালের ২১ জুলাই সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুরে পাহাড় ধসে প্রাণ হারিয়েছিলেন একই পরিবারের পাঁচজন। একই বছরের ১২-১৪ জুন ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড় ধস ও পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রাম জেলায় ৩৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছে বলে জেলা প্রশাসনের এক প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২৭ জন রাঙ্গুনিয়ায় এবং ৪ জন ছিলেন চন্দনাইশে।
২০১৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানার জালালাবাদ মাঝের ঘোণা এলাকায় পাহাড় ধসে মারা যান একই পরিবারের দু’জন। ভোর সাতটার দিকে সংঘটিত ওই পাহাড় ধসে নিহত দু’জন সম্পর্কে ছিলেন মা-মেয়ে। একই বছরের ১৮ জুলাই ঈদুল ফিতরের রাতে আধ ঘণ্টার ব্যবধানে পৃথক দুটি স্থানে পাহাড় ও দেয়াল ধসে ৫ শিশুসহ প্রাণ হারিয়েছিল ৬ জন। এর মধ্যে রাত দু’টার দিকে বায়েজিদ থানার আমিন কলোনির শাহাজাহান মিস্ত্রীর ঘরে পাহাড় ধসে তিন ভাই-বোন এবং এর আগে রাত দেড়টার দিকে লালখান বাজারের পোড়া কলোনি এলাকায় দেয়াল ধসে মা-মেয়েসহ মারা যান ৩ জন।
২০১৪ সালে পাহাড় ধসে কোনো প্রাণহানি ঘটে নি। তবে টানা বর্ষণের ফলে ২০ জুন পৃথক তিনটি স্থানে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে চেরাগী পাহাড় রাজাপুকুর লেনের দয়াময়ী কলোনিতে সৃষ্ট পাহাড় ধসের ঘটনায় চারজন আহত হয়েছেন। এছাড়া নগরীর প্রবর্তক মোড় এবং টাইগারপাস এলাকায় সংঘটিত পাহাড় ধসের ঘটনায় কেউ হতাহত না হলেও আশেপাশের লোকজনের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে।
২০১৩ সালের ২৮ জুলাই ভোর সোয়া পাঁচটার দিকে লালখান বাজারের টাংকির পাহাড়ে ধসের ঘটনায় মা-মেয়ের মৃত্যু হয়েছিল। একই বছরের ৯ জানুয়ারি খুলশী থানার ইস্পাহানি গোল পাহাড় সি-গেইট এলাকায় সাহারা খাতুন নামে এক গৃহবধূ মারা যান।
২০১২ সালের ২৬ জুন নগরীর চার স্থানে পাহাড় ধসে প্রাণ হারায় ১৮ জন। এর মধ্যে খুলশী আকবর শাহ হাউজিং এলাকাস্থ ইয়াছিন কলোনিতে ৭ জন, বিশ্ব কলোনিতে একই পরিবারের ৫ জন এবং উত্তর পাহাড়তলী জালালাবাদ আঁন্দারমানিকে একই পরিবারের ২ জন এবং মক্কীঘোণায় ৪ জন মারা যান।
২০১১ সালের ১ জুলাই বাটালি হিলের প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে পড়লে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়েন ১৭ জন। ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট মতিঝর্ণায় পাহাড় ধসে মারা যায় ১১ জন। ২০০৭ সালের ১১ জুন নগরীর সাতটি স্থানে পাহাড় ধসের ঘটনায় প্রাণ হারায় ১২৭ জন। এরমধ্যে সেনানিবাস সংলগ্ন বেসরকারি মালিকানাধীন লেবু বাগান, সেনা লেডিস ক্লাব, কাছিয়া ঘোনা ও ওয়ার্কসপ ঘোনায় প্রাণ হারান ৭২ জন, সিএমপি পুলিশ লাইন সংলগ্ন কুসুমবাগ এলাকায় ১৪ জন, বায়োজিদ বোস্তামি এলাকায় ৫ জন, সেকান্দার পাড়া এলাকায় ৯ জন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ৫ জন মারা যান।
বিভিন্ন নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চট্টগ্রাম শহরে সর্বপ্রথম পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে ১৯৯৯ সালের ১৩ আগস্ট। ওই দিন সিরআরবি পাহাড়ের একাংশের সীমানা প্রাচীরসহ পাহাড় ধসে মারা যান ১০ জন। পরের বছর অর্থাৎ ২০০০ সালের ২৪ জুন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আবাসিক এলাকাসহ নগরীতে সংঘটিত আরেকটি পাহাড় ধসে মারা যান ১৩ জন। সর্বশেষ গত ১৩ অক্টোবর দিবাগত রাত ২টায় আকবর শাহ থানার পূর্ব ফিরোজ শাহ কলোনি এলাকায় পাহাড় ধসে একই পরিবারের তিনজন এবং রহমান নগরে দেয়াল ধসে মারা যান একজন।
তথ্য সুত্রঃ দৈনিক আজাদী।

ব্রেকিং নিউজ :
Shares