একজন অর্থবান ও পরিশুদ্ধ মুহিত শূন্য হাতে চির শায়িত, শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন,সিলেটে হবেন সমাহিত। 


rafiq প্রকাশের সময় : মে ১, ২০২২, ১৫:২৮ / ১৫৪
একজন অর্থবান ও পরিশুদ্ধ মুহিত শূন্য হাতে চির শায়িত, শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন,সিলেটে হবেন সমাহিত। 

একজন অর্থবান ও পরিশুদ্ধ মুহিত শূন্য হাতে চির শায়িত, শহীদ মিনারে  শ্রদ্ধা নিবেদন, সিলেটে হবেন  সমাহিত।

বিডি সংবাদ ৭১ প্রতিবেদক ঃ একজন পরিশুদ্ধ মানুষ। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী। আলোকিত মানব। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, অর্থনীতি, সমাজনীতি, কূটনীতি, গবেষণা, সাহিত্য, পরিবেশ, শুদ্ধ সাংস্কৃতিক আন্দোলন- সর্বত্র ছিলেন উজ্জ্বল নক্ষত্র। আধুনিক বাংলাদেশের উন্নয়নশীল অর্থনীতির রূপান্তরের অন্যতম স্বপ্নবাজ নায়ক আবুল মাল আবদুল মুহিত সরলতা, সততা ও সত্য কথনে জীবন্ত কিংবদন্তি। গত শুক্রবার রাতে এই জীবন্ত কিংবদন্তির জীবনাবসানে শোকাচ্ছন্ন গোটা দেশ। গতকাল শনিবার ফুলেল শ্রদ্ধায় তার ফেলে যাওয়া প্রায় ৯ দশকের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনকে স্মরণ করেছে জাতি। আজ রবিবার সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে তৃতীয় জানাজা শেষে নগরীর রায়নগর এলাকায় পারিবারিক কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন এই কাজপাগল মানুষটি। রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতিতে রেখে যাওয়া দীর্ঘ ৮৮ বছরের সাধনা তাকে স্মরণে রাখবে অনন্তকাল।
বাংলাদেশের ইতিহাসে টানা দশটিসহ মোট ১২টি বাজেট দিয়ে অনন্য রেকর্ড সৃষ্টি করে গেছেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি একজন সফল, উচ্চাভিলাষী, স্বপ্নবাজ ও রেকর্ডধারী অর্থমন্ত্রী ছিলেন। ৮৯ হাজার কোটি টাকার বাজেট তিনি উন্নীত করেছিলেন ৫ লাখ কোটি টাকায়। রাজস্ব আদায় বা কর বাড়ানোর ক্ষেত্রেও তিনি দেখিয়েছেন চমক। তার সেই স্বপ্নের সফল বাস্তবায়নের সুফল পাচ্ছে দেশবাসী। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ফোরামে বাংলাদেশের সম্পৃক্তি ও সমৃদ্ধিতে তিনি এক রূপান্তরের নায়ক। ইতিহাস-ঐতিহ্য সচেতন এই আলোকিত গুণীজন একজন ন্যায়নিষ্ঠ, সজ্জন চিৎপ্রকর্ষবিদ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের মনোনয়নে সিলেট-১ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ২০১৮ সাল পর্যন্ত অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে।
মহকুমা হাকিম থেকে বেশি বাজেটের অর্থমন্ত্রী : আবুল মাল

আবদুল মুহিতের জন্ম ১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি। তৎকালীন সিলেট জেলা মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা আবু আহমদ আবদুল হাফিজ ও সৈয়দা শাহার বানু চৌধুরীর ১৪ সন্তানের মধ্যে তিনি তৃতীয়। সংস্কৃতিমনা পারিবারিক আবহে বেড়ে ওঠা মুহিত কৈশোরেই সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় জড়িয়ে পড়েন। শিশু-কিশোর সংগঠন ‘মুকুল ফৌজ’ গঠন করে নেমে পড়েন সৃজনশীল চর্চায়। ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী মুহিত ১৯৪৮ সালে স্কুল ছাত্র হিসেবে প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দেন এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে জড়িত হন। ১৯৪৯ সালে সিলেট সরকারি পাইলট হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে কৃতকার্য হন। ১৯৫১ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় প্রথম স্থান, ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ (অনার্স) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম এবং ১৯৫৫ সালে এমএ পাস করেন। ছাত্রজীবনে সলিমুল্লাহ হল ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি মুহিত ১৯৫৬ সালে লাহোরস্থ সিভিল সার্ভিস একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ শেষে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। মহকুমা হাকিম (এসডিও) হিসেবে তার প্রথম কর্মস্থল ছিল মুলতান। পরবর্তীতে তিনি কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৫৭-১৯৫৮ সালে ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। তাছাড়াও ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স অব পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এ ডিগ্রি অর্জন করেন।।
১৯৬০-১৯৬৯ সালে তিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের উপসচিব থাকাকালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের ওপর ১৯৬৬ সালে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন তিনি। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে এটিই ছিল এ বিষয়ে প্রথম প্রতিবেদন। ১৯৬৯ সালে এএমএ মুহিত যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তান দূতাবাসের ইকোনমিক কাউন্সিলর পদে যোগ দেন। একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনিই প্রথম কূটনৈতিক যিনি বাংলাদেশের পক্ষে পাকিস্তানের কূটনৈতিক দায়িত্ব ত্যাগ করেছিলেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা সচিব এবং ১৯৭৭ সালে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়। সাহিত্যের ছাত্র থেকে অর্থনীতির জটিল জগতের অনুচর মুহিত ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ছিলেন এবং ১৯৮১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন। ১৯৮২ সালে ২৪ মার্চ এইচ এম এরশাদ ক্ষমতা দখল করলে তাকে অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী করার প্রস্তাব দিলে তিনি শর্ত সাপেক্ষে রাজি হন। শর্তটি ছিল, নির্দলীয় সরকার গঠন করে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। এরশাদ কথা না রাখলে দুই বছরের মাথায় মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন মুহিত। এরপর তিনি বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। তাছাড়া ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও ইফাদে কাজ করে নন্দিত হন। আমেরিকার প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং ফেলো হিসেবে অধ্যাপনা করেন। পরে তিনি নিজ এলাকা সিলেটকে ‘আলোকিত সিলেট’ হিসেবে রূপায়ণের স্বপ্ন নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। তিনি বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। স্বাধীনতাযুদ্ধে অনন্য ভূমিকা রাখার স্বীকৃতি হিসেবে সরকার তাকে ২০১৬ সালে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে। মুক্তিযুদ্ধ, জনপ্রশাসন, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক বিষয়ে মুহিত বই লিখেছেন ৪০টি। তার স্ত্রী সৈয়দা সাবিয়া মুহিত একজন ডিজাইনার। তিন সন্তানের মধ্যে কন্যা সামিনা মুহিত ব্যাংকার ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞ। বড় ছেলে সাহেদ মুহিত স্থপতি এবং ছোট ছেলে সামির মুহিত শিক্ষক।
শহীদ মিনারে সর্বস্তরের শ্রদ্ধা : একদিন লড়াই করে আদায় করেছিলেন যে মাতৃভাষার মর্যাদা, সেই মর্যাদার প্রতীক কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শেষ যাত্রায় জাতির শ্রদ্ধায় সিক্ত হলেন দেশ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ অসাম্প্রদায়িক এমএ মুহিত। বাংলাদেশের উন্মেষ ও রূপান্তরের এই পুরোধা ব্যক্তিত্বের কফিনে রাষ্ট্রপতির পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এস এম সালাউদ্দিন ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তার সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কবির আহমেদ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর পক্ষে সংসদের সার্জেন্ট এন্ড আর্মস কমডোর এম নাইম রহমান শ্রদ্ধা জানান। সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতারা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান দলের উপদেষ্টা পরিষদের প্রয়াত এই সদস্যের প্রতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আখতারুজ্জামান, ঢাকা দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজ?লে নুর তাপস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই এসোসিয়েশন, পূজা উদযাপন পরিষদ, জালালাবাদ এসোসিয়েশন, অর্থ মন্ত্রণালয়, হিন্দু ধর্মীয় কল?্যাণ ট্রাস্ট, ভারতীয় হাইক?মিশন, ঢাকা মেট্রো প?লিটন চেম্বার অফ কমার্স, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সার্বজনীন পূজা উদযাপন ক?মিটি, হিন্দু- বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, জাতীয় বিশ্ব?বিদ?্যালয়, বাংলা?দেশ এড?মি?নিস্ট্রেশন সা?র্ভিস এ?সো?সিয়েশন, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, প?রি?বেশ বাঁচাও আ?ন্দোলন, বঙ্গবন্ধু ফাউ?ন্ডেশন শ্রদ্ধা জানায়।
খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ আবুল মাল আবদুল মুহিতের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয় রাজধানীর গুলশান আজাদ মসজিদে। দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে। বেলা দেড়টার দিকে নানা স্তরের মানুষ এই জানাজায় অংশ নেন। সেখান থেকে মরদেহ নেয়া হয় জন্মস্থান সিলেটে।
আজ চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন : আজ রবিবার সিলেট নগরীর দুপর দুইটায় আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে জানাজা শেষে রায়নগর এলাকায় পারিবারিক কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হবে,
সাবেক এই অর্থমন্ত্রীকে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেন, আমাদের পৈত্রিক বাড়ি সাহেব বাড়ির পেছনে আমাদের কবরস্থান আছে। যেখানে আমাদের বাবা, মা, দাদা-দাদি সবার কবর রয়েছে। সেখানে তাকে দাফন করা হবে।

ব্রেকিং নিউজ :
Shares